বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ঘটনাবহুল দেশ। কিন্তু সে অর্থে আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্য নেই। আমাদের জাতীয় নেতারা আত্মজীবনীও লেখেননি। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: জাতীয় নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মজীবনী লিখেছেন। যেমন আবুল মনসুর আহমেদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের অনেকেই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখেছেন। তবে হ্যাঁ, সেই অর্থে সে রকম নেই। যেমন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর আত্মজীবনী আছে, জ্যোতি বসু আত্মজীবনী লিখেছেন। সেই অর্থে আমাদের এখানে সে রকম নেই। আসলে আমাদের এখানকার রাজনীতির সঙ্গে লেখাপড়ার ব্যাপারটাই একটু কম আছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক। এটা আমাদের দৈন্য।
আপনার বইতে আছে, পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। নেতৃত্বটা পরে অন্যদের হাতে চলে গেল। আপনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। এর কারণ কী?
উত্তর: কথাটা যেভাবে বলছেন সেভাবে সঠিক নয়। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, মার্কসবাদী-লেলিনবাদী, তাঁদের প্রথম যে কংগ্রেস হয় ১৯৬৬ সালে, সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পুরো স্বাধীন পূর্ববাংলা করতে হবে। তারপর অন্য কতকগুলো, কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও, যাদের অনেকগুলো খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিছু স্লোগানও দিত, কিছু প্রচার-প্রপাগান্ডাও করত, কিছু অস্ত্রশস্ত্রও জোগাড়-টোগাড় করেছিল, দিস ইজ ফ্যাক্টস। কিন্তু স্বাধীনতা-সংগ্রামকে বেগবান করা এবং সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়া, বা স্বাধীনতার প্রেরণাটা নিয়ে আসা, এটা করেছে আওয়ামী লীগ এবং প্রধানত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। এর আগেও মওলানা ভাসানী একবার হুমকি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো সে জায়গায় এগোয়নি। এর কারণটা কিছু কিছু আমার বইয়ের মধ্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। একটা হচ্ছে যে, কমিউনিস্ট পার্টি পুরোটা জাতীয় সংগ্রামের যদি নেতৃত্ব নেয় তো ভালো কথা, কিন্তু যদি সেই জাতীয় সংগ্রামে বুর্জোয়াদের প্রভাব অনেক অনেক বেশি থাকে সমাজের ওপর, সো হোয়েন দে টেক ইট আপ, তখন তাদের পক্ষে অনেক ইজি হয় এবং সেটা ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারে।
বইটির ‘পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয়’ পর্বে দেশের বাইরের কথা আছে। পশ্চিমবঙ্গের দিকে যদি তাকাই, সেখানে বাম রাজনীতিকরা জনসমর্থন পাচ্ছে, দীর্ঘদিন তারা ক্ষমতায় থাকছে। বাংলাদেশে বাম রাজনীতিকরা জনসমর্থন পাচ্ছেন না কেন?
উত্তর: দেখেন, পশ্চিমবঙ্গে পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গের ঠিক লাগোয়া স্টেট হচ্ছে উড়িষ্যা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, উড়িষ্যায় নেই কেন। একই পার্টি, একই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, একই নীতি, পাশাপাশি রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতি ডেফিনেটলি খুবই শক্তিশালী। আজকে প্রায় তিন দশক ধরে তারা ক্ষমতায় আছে এবং বোধহয় আরো বহুদিন থাকবে। ইলেকশনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতায় আসছে, অথচ উড়িষ্যায় নেই। এটার মূল কারণ হচ্ছে সাংগঠনিক নেতৃত্ব। সেখানে এমন একটা সাংগঠনিক নেতৃত্ব ছিল, কমরেড মোজাফফর আহমেদের নিজের হাতে তৈরি, প্রমথ দাশগুপ্তের হাতে এই পার্টির বিকাশ হয়েছে। ভুলভ্রান্তি তারাও করেছে, তারপরেও একধরনের আদর্শবোধকে আঁকড়ে রাখার যে বিষয়টি, সেটি ছিল। আমাদের দেশেও কিন্তু ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন বেশ জোরদার ছিল কোনো সন্দেহ নেই এবং অলমোস্ট বুর্জোয়াদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিন্তু তারা সমানে সমানে পাল্লা দিতে পারত, দিয়েছিলও-ষাটে, ঊনসত্তরে। সিক্সটির মুভমেন্টের সময় এ রকম দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কতকগুলো বড় রকমের ভুল আমরা করেছি। একটা হচ্ছে নকশাল আন্দোলন। নকশাল আন্দোলন ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক অংশকে। আরেকটা হচ্ছে, যদিও সব কমিউনিস্ট নয়, একটা অংশ স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিকৃতভাবে চিত্রিত করল এবং তারা একটা বিকৃত ভূমিকা পালন করল—‘দুই কুকুরে কামড়াকামড়ি’ ইত্যাদি বলে। আরেকটি অংশের মধ্যে দেখা গেল বুর্জোয়া নেতৃত্বের প্রতি মোহগ্রস্ততা এবং তার লেজুড়বুত্তি, আরও অনেক কারণ আছে। কিছু সাংগঠনিক বিষয়ও আছে, যেমন এত বিভক্তি। মতাদর্শিক কারণ যেমন আছে, পাশাপাশি ব্যক্তিগত বিষয়, নেতৃত্বের মোহ—এই সমস্ত বিষয়ও কাজ করেছে বলে আমার কাছে মনে হয়।
এই বইয়ে আমি চেষ্টা করেছি আমার দেখা জিনিসগুলো সামনে আনার। হ্যাঁ, আমি তো একটা চরিত্র বটেই। এখানে অনেক বড় বড় চরিত্র আছে, আমি তো তার ধারেকাছেও না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী আর পৃথিবীর ক্ষেত্রে আসলে অন্যান্য চরিত্রও আছে।
‘শতাব্দী পেরিয়ে’ আত্মজীবনী হলেও তার যোগ ইতিহাসের সঙ্গে, যেখানে আপনি নিজেও একজন চরিত্র। এই বই যদি থাকে এই চরিত্রটিও থাকবে। বইয়ের রনো চরিত্রটার দিকে তাকালে আপনার কী অনুভূতি হবে?
উত্তর: এই বইয়ে আমি চেষ্টা করেছি আমার দেখা জিনিসগুলো সামনে আনার। হ্যাঁ, আমি তো একটা চরিত্র বটেই। এখানে অনেক বড় বড় চরিত্র আছে, আমি তো তার ধারেকাছেও না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী আর পৃথিবীর ক্ষেত্রে আসলে অন্যান্য চরিত্রও আছে। আমি বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এই বাংলাদেশে বসবাস করেছি, এখানেই বড় হয়েছি, চোখের সামনে অনেকগুলো ঘটনা দেখেছি, পার্টিসিপেটও করেছি, সেই হিসেবে যেটুকু থাকার সেটুকু থাকবে। এর বেশি আর কী? ‘রনো’ চরিত্রটির লিমিটেশন আর সম্ভাবনাগুলো পাঠকরাই বিচার করবেন। আমার পক্ষে বলা খুবই কঠিন।
শুরু করার সময় আপনি ভাবেননি বইটা এত বড় হবে। অনেক প্রসঙ্গ আপনি হঠাৎ থামিয়ে দিয়েছেন কলেবর বড় হয়ে যাবে এ আশঙ্কায়। সামনের দিনগুলোতে বইটির সম্পূরক হিসেবে আরেকটি বই কি লিখবেন?
উত্তর: না, এ রকম কোনো চিন্তা নেই। হ্যাঁ, বইটি অনেক বড় হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকগুলো প্রসঙ্গ থামিয়ে দিতে হয়েছে। একটা বি-শা-ল বই করে তো লাভ নেই। আসলে আমি তো ইতিহাস লিখছি না। ডিটেলসে যাওয়ারও দরকার নেই। প্রসঙ্গ থামিয়ে দিলেও আমার মনে হয়, যে কথাগুলো বলতে চেয়েছি, সেগুলো আভাস-ইঙ্গিতে বলে গেছি। যদি ইতিহাসের বই লিখতাম আরো বিস্তারিত লিখতাম।
এই বইমেলায় আপনার কোনো বই বের হচ্ছে? এখন আপনি কী লিখছেন?
উত্তর: কিছু বই লিখছি, তবে এ বইমেলায় বেরোবে না। দুটো বই আমার হাতে আছে। একটা হচ্ছে মৌলবাদ প্রসঙ্গে—আমাদের দেশের ক্ষেত্রে মৌলবাদের জন্ম ও বিকাশ সংক্রান্ত। এটা কমবেশি রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় নিয়ে। আরেকটা বই, যার প্রায় অর্ধেক লেখা হয়ে গেছে, ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব—এই সময়টার ইতিহাস এবং মার্ক্সবাদী দর্শনসহ যেসব আইডিয়া এসেছে, সেসব আইডিয়া আর ওই সময়ের ডেভেলপমেন্টটাও তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে এই বইয়ে।