আমিরুল মোমেনীন মানিক: আপনি কবিতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,/ পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ’, এখনো কি এই পঙ্ক্তিগুলো বিশ্বাস করেন?
আল মাহমুদ: অবশ্যই। আমার বিশ্বাসে বাঁকবদল হয়েছে বলেই, প্রশ্নটি হয়তো তুলেছ। বিষয় হলো, আমি ধর্ম বলতে বোঝাতে চেয়েছি, মানুষের সামগ্রিক জীবনাচরণকে। একজন মানুষ যদি প্রকৃত মানুষ হতে চায়, তবে অবশ্যই তাকে সাম্যবাদী, ন্যায্যবাদী হতে হবে। এবং সাম্য, ন্যায্যতা ধারণ করতে তোমাকে যে একটি তত্ত্বের মধ্যেই থাকতে হবে, তেমনটি নয়, মানুষ হিসেবে সাধারণ দায় থেকেই তোমাকে সুষম বণ্টনের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
মানিক: আপনার পঙ্ক্তিটি অনেক তরুণকে অনুপ্রেরণা জোগায়। অনেক বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা তাদের স্লোগান হিসেবে এটি ব্যবহার করে। কেমন লাগে আপনার?
আল মাহমুদ: ভালো লাগে। তবে কবিতার গায়ে ‘বামপন্থী’, ‘ডানপন্থী’ তকমা দেওয়া ঠিক না। মানুষের প্রয়োজনে কবিতা তার পাশে দাঁড়ায়। সেখানে মানুষ পরিচয়ই মুখ্য, কে বামপন্থী কে ডানপন্থী, সেটি নয়।
মানিক: অনেকেই বলে থাকেন, ১৯৭২ সালের পরে আপনার একটা বাঁকবদল হয়েছে, বিশ্বাসের বাঁকবদল...।
আল মাহমুদ: এটি স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। এমনিতে তো আর বদলায় না মানুষ। আমি পড়াশোনার মধ্য দিয়ে এসেছি। ব্যাপক পড়াশোনা করেছি। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, নানা কারণে এটি হয়েছে। ইউরোপে গিয়েছি আমি। ফ্রান্সের প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ফুটপাত ধরে হেঁটেছি। পেঁজা তুলার মতো তুষারপাত হচ্ছে। একাকী হাঁটছি।
মানিক: ভাষা আন্দোলনও করেছেন আপনি। ছোট ছিলেন তখন। কিশোর বয়সে ১০ লাইনের একটি কবিতা লেখার কারণে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, পুলিশ হুলিয়া জারি করেছিল।
মানুষ যেমন সুখে-দুঃখে কাতর হয়, ভালোবাসায় আনন্দ পায় তেমনি আমিও সুখে-দুঃখে কাতর হয়েছি, প্রেমে আকুল হয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি।
মানিক: সেই সময় এত সাহস কীভাবে এল, এত ঝুঁকি কীভাবে নিয়েছিলেন?
আল মাহমুদ: যেহেতু কবিতাই আমি করতাম, কাব্যচর্চার ভেতরেই বড় হয়েছি, এটা আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আর আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই সাহসী মানুষ ছিলেন। তাঁদের মনোবল থেকেও আমার মনে সাহস সৃষ্টি হয়েছে। আমি কোনো কিছু করলে দৃঢ়তার সঙ্গে করেছি। কিছু বললে সে বলার একটা কার্যকরণ সম্পর্কসূত্র থেকেছে। এখনো তা–ই করি।
মানিক: এই চেতনা থেকেই কি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন আপনি?
আল মাহমুদ: হ্যাঁ। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। তখন আমি কলকাতায় ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে প্রচারণার দরকার ছিল, তাতে আমি অংশগ্রহণ করেছি।
মানিক: মুক্তিযুদ্ধের এ অভিজ্ঞতা নিয়েই তো আপনি কাবিলের বোন লিখেছেন। অনেকের মতে, এটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
আল মাহমুদ: শুধু মুক্তিযুদ্ধ কেন? বাংলা ভাষায় কয়টা উপন্যাস আছে। আঙুলে গোনো। খুব একটা বেশি তো নেই। তার মধ্যে কাবিলের বোন একেবারে পরিপূর্ণ একটা উপন্যাস। উপন্যাসের যে আঙ্গিক, রীতি, স্থাপত্যকৌশল—এসব পুরোপুরি মেনে এটি লিখেছি আমি। এর প্রশংসা আছে, সমালোচনাও আছে। কিন্তু আমি যে প্রশংসা পেয়েছি, তা অল্প বাঙালি লেখক পেয়েছেন। আমার লেখার জন্য জীবিতকালে আমি সম্মান কম পাইনি। আমার কোনো নালিশ নেই কারও বিরুদ্ধে।
মানিক: ছড়াও লিখেছেন আপনি। তাতেও সফল হয়েছেন। আবার ১৯৭১-এর পরে গল্পও লিখেছেন। সফলতা এসেছে সেখানেও...।
আল মাহমুদ: এটা একজন লেখকের স্বাভাবিক কর্ম। ছোটগল্প আমি আগে থেকেই লিখতাম। কমবেশি লিখতাম। সেসব দুই খণ্ডে বেরিয়েছে।
মানিক: নিজের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আল মাহমুদ: আমি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ লিখেছি। এর সংখ্যা অনেক। একেবারে কম না। খণ্ড খণ্ড হলে ১০ খণ্ড হবে। বেশ মোটা। এই যে লিখেছি, বিরামহীনভাবে লিখেছি—এখনো লিখছি। আর এর মধ্য দিয়ে মানুষকে ভালো করে দেখা, মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করা, মানুষের আত্মাকে বর্ণনা করা। এটাই তো আমি করেছি। যতটুকু পেরেছি করেছি।
মানিক: ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে আসি, অনেকে বলে থাকেন, আপনি গান লেখেননি।
আল মাহমুদ: কথাটা তো ঠিক। কারণ, আমার জন্ম হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এটি আসলে তো গানের এলাকা। বহু বড় বড় ওস্তাদের জন্ম হয়েছে এখানে। আমার সমসাময়িক একজন বড় সংগীতজ্ঞ নাম বাহাদুর হোসেন খাঁ। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। বেশি দিন আমরা একসঙ্গে থাকতে পারিনি। কারণ, পরে তিনি চলে গেলেন কুমিল্লায়। বাহাদুর হোসেন খাঁ, তাঁর পরিবারের লোকজন আমার ক্লাসমেট ছিল। যেমন রাজা হোসেন খাঁ। এরা হলো সংগীতের পরিবার। এদের ছেলেমেয়েরা আবার অন্য রকম। ঠিক আমাদের মতো না। তারা যন্ত্রে পারদর্শী। যদি আমি কবিতা না লিখতাম, তাহলে মিউজিশিয়ান হতাম। গানের লোক হতাম। শিল্পী হতাম কি না, জানি না। কিন্তু গান আমার বিষয় হতো।
মানিক: শিল্পী হলে কার মতো শিল্পী হতেন?
আল মাহমুদ: নিজের মতোই হতাম। তবে উপমহাদেশের মিয়া তানসেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আমাকে ভীষণভাবে টানেন। কেন যেন মনে হয়, শিল্পী হলে তাঁদের মতো সাধনা করে আমি এক জীবন কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আমার হলো না।
মানিক: কিন্তু আপনি তো কবিতার পাশাপাশি গান লিখতে পারতেন। আপনার সমসাময়িক সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান তাঁরা তো এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ করেছেন।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কবিতায় এতটা মগ্ন ছিলাম জীবনব্যাপী যে এভাবে চিন্তা করিনি কখনো। তবে হ্যাঁ, আমার কবিতা নিয়ে গান হয়েছে। তুমিই তো আমার ‘নোলক’ কবিতায় সুর দিয়ে গান বানিয়েছ। ওটা দারুণ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় করেছেন ফেব্রুয়ারির ‘একুশ তারিখ দুপুর বেলায় অক্ত’ এই কবিতাটি। প্রতুলের উদারকণ্ঠে প্রাণ পেয়েছে এ কবিতা, অসাধারণ গান হয়ে উঠেছে। পরে কবিতাটি গানের সুরে শাকিলা জাফরের (এখন শর্মা) কণ্ঠেও শুনেছি। এসব আমি না চাইতেই হয়েছে। ভবিষ্যতেও তরুণেরা আমার কবিতা আর ছড়াকে সুরারোপ করে গাইবে নিশ্চয়ই। আমি থাকি বা না থাকি।
মানিক: আপনার গল্প নিয়ে ইদানীং নাটকও হচ্ছে। আপনি কি জানেন?
আল মাহমুদ: হ্যাঁ। অনিমেষ আইচ করেছে একটা। ও আমার কাছে অনুমতি নিয়েছে। আরও দু–তিনজন করেছে। এ মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না। কলকাতায় আমার ‘জলবেশ্যা’ গল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে।
মানিক: এক জীবনে আপনি অনেক পেয়েছেন। আপনার অতৃপ্তি কোথায়?
আল মাহমুদ: আমার জীবন হলো কবির জীবন। স্মৃতি-বিস্মৃতির জীবন। সব একটু একটু করে পাশ কাটিয়ে আমি বিস্মৃতি অতিক্রম করে চলে যাচ্ছি। আমি মানুষ। মানুষের অতৃপ্তি থাকে।
কিন্তু তা আমি বাজারে বলে বেড়াই না। যা পাইনি তা নিয়ে কোনো খেদ নেই। কারণ, তা আমার ভাগ্যে ছিল না। কিন্তু জীবনে যা পেয়েছি, তার মূল্য এত বেশি এবং তাতে আমি এত অবাক হয়েছি যে কী চাওয়া-পাওয়ার ছিল, তা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। মানুষ যেমন সুখে-দুঃখে কাতর হয়, ভালোবাসায় আনন্দ পায় তেমনি আমিও সুখে-দুঃখে কাতর হয়েছি, প্রেমে আকুল হয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। কম তো পাইনি আমি। যথেষ্ট পেয়েছি। একজন মানুষ এক জীবনে এত পায় না। আমি এ জন্য কৃতজ্ঞ আমাদের দেশ ও জনগণের কাছে। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার কাছে। আমার পরিবেশের কাছে, প্রকৃতির কাছে। সবার কাছে।