শারফিন শাহ: আপনার জীবন বর্ণাঢ্য। মুক্তিসংগ্রামী, শিক্ষক, গবেষক, সংস্কৃতিসাধক কতভাবেই না নিজেকে আপনি মেলে ধরেছেন জাতির সামনে। ঠিক কোন পরিচয়ের মধ্যে নিজেকে সবচেয়ে উজ্জ্বলরূপে খুঁজে পান?
আনিসুজ্জামান: অবশ্যই শিক্ষক পরিচয়ের মধ্যে। আমি আসলে শিক্ষকই হতে চেয়েছি। প্রতিদিন ক্লাসরুমে প্রবেশ করে যখন ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্নালু চোখগুলো দেখতাম, তখন মনে হতো, এদের প্রতি আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমি যদি ঠিকভাবে পথ দেখাতে না পারি, তবে এদের স্বপ্নগুলো অধরাই থেকে যাবে। তাই শিক্ষকতায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছি।
শারফিন: আপনি ছাত্রজীবনে অনেক মহান শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছেন। এঁদের মধ্যে কোন শিক্ষকের প্রভাব আপনার ওপর সবচেয়ে বেশি পড়েছে বলে মনে হয়?
আনিসুজ্জামান: একজনের নাম যদি বলতে হয়, তবে মুনীর চৌধুরীর কথা বলব। যদিও আমি এক বছর তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম, তবু তাঁর পড়ানোর স্টাইলটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। চমৎকার পড়ানোর দক্ষতা বহন করতেন তিনি। প্রচুর বইপত্রের খবর জানতেন এবং ছাত্রছাত্রীদের জানাতেন। আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘ভালো শিক্ষক হতে চাইলে বইপত্র ঘাঁটতে হবে। যে শিক্ষক ভালো বই সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, তাঁর বিদ্যার দৌড় ওই সনদপত্র পর্যন্ত।’ সেই থেকে আমি যত দূর সম্ভব বইপত্রের বিষয়ে সজাগ থাকার চেষ্টা করেছি।
শারফিন: ভালো ছাত্র ছিলেন আপনি। আপনাদের কালে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করতেন, তাঁরা সিএসপি অফিসার হতে চাইতেন। আপনার মনেও কি তেমন আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল কখনো?
আনিসুজ্জামান: আগেই বলেছি, আমি শুধু শিক্ষকই হতে চেয়েছি। অন্য কোনো পেশার প্রতি আমার লোভ ছিল না। একজন শিক্ষকের বাড়তি লোভ থাকা উচিতও নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাঁকে হতে হবে নির্মোহ। জ্ঞানের চর্চা করতে গেলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করা জরুরি। মনে রাখতে হবে রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক বা ব্যবসায়ীর মতো বৈষয়িক পরিমণ্ডলের মানুষ নন শিক্ষক। একজন শিক্ষক মানুষ তৈরি করবেন, তাঁকে অবশ্যই মানুষের কথাই ভাবতে হবে।
এখন মেধাবী শিক্ষক যেমন আছেন, তেমন মেধাহীন শিক্ষকও আছেন। আমার মনে হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটা গলদ থেকেই যায়। অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ে যায় নানা কারণে। শুধু ফলাফল দেখে নিয়োগ না দিয়ে ভাষাগত দক্ষতা ও পড়ানোর দক্ষতার ওপরও জোর দেওয়া উচিত।আনিসুজ্জামান
শারফিন: দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের আলোকে এখকার শিক্ষকদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনিসুজ্জামান: মূল্যায়নের ভার শুধু আমার ওপর চাপানো ঠিক নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, এখন মেধাবী শিক্ষক যেমন আছেন, তেমন মেধাহীন শিক্ষকও আছেন। আমার মনে হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটা গলদ থেকেই যায়। অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ে যায় নানা কারণে। শুধু ফলাফল দেখে নিয়োগ না দিয়ে ভাষাগত দক্ষতা ও পড়ানোর দক্ষতার ওপরও জোর দেওয়া উচিত। এমনকি গবেষণাকর্ম থাকলে তারও আলাদা গুরুত্ব থাকা উচিত। আরেকটা বিষয় আমার চোখে পড়েছে, আমাদের সময় যাঁরা গবেষণা করতেন, তাঁরাই পদোন্নতির আশা করতেন। এখন গবেষণা না করেও অনেকে পদোন্নতি পেয়ে যান। এই ব্যাপারটি দুঃখজনক।
শারফিন: পড়ালেখা ও গবেষণার কাজে বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছেন আপনি। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার কোনো পার্থক্য চোখে পড়েছে?
আনিসুজ্জামান: পড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য নেই। কিন্তু সিলেবাসের ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান। তারা ভাষার ওপর অনেক বেশি জোর দেয়। আর সংস্কৃতিবিষয়ক কোর্স সব বিভাগেই রয়েছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বন্ধু ছিল, তাঁর রুমে আমি দেখেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের পোস্টার। সে ইতিহাসের অধ্যাপক, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের চলচ্চিত্র পড়াচ্ছে। তা–ও আবার ভারতীয় চলচ্চিত্র। আমাদের এখানে এমনটা হলে তো বলবে, সিলেবাসের বাইরে পড়ানো হচ্ছে। ওখানে কালচারাল স্টাডিজটা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে ইতিহাস, দর্শন, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্যের কোর্স থাকবেই।
শারফিন: ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর। এমআইটির মতো বড় তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিদ্যাপীঠেও কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয় মেজর ও মাইনর হিসেবে পড়ানো হয়। আমাদের এখানে কিন্তু এমনটা নেই।
আনিসুজ্জামান: এটা নীতিনির্ধারকদের অবহেলার কারণে ঘটে। আমি মনে করি, সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থাকা উচিত। উচ্চশিক্ষার পথ যত বেশি প্রশস্ত করা যায়, ততই মঙ্গল।
হিজাব পরা অনেক মেয়ের সঙ্গেই আমি কথা বলে দেখেছি, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকীর্ণতা নেই। তারা যে শখ করে হিজাব পরে, এমনটাও নয়। বেশির ভাগই পরে পারিবারিক চাপে। যখন চাপ কেটে যায়, তখন তারা মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস ফেলে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কোনো রকম বিরূপ মনোভাব দেখিনি। রাজনীতিই সমস্যার মূলে। ধর্ম নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাই সংকটের হোতা।আনিসুজ্জামান
শারফিন: আপনি তো দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন—চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কেমন মনে হয়েছে?
আনিসুজ্জামান: শিক্ষা ও গবেষণার মান বিবেচনায় অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়াটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার ছিল। এখন যাঁরা শিক্ষকতায় আসেন, তাঁরা কেমন বোধ করেন জানি না, আমার অভিজ্ঞতা ছিল আনন্দঘন। এর একটি কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বই ও পত্রপত্রিকার প্রাচুর্য ছিল। এ ছাড়া ছিল গবেষণা ও পড়াশোনার সুবর্ণ সুযোগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসবের কোনোটাই ছিল না।
শারফিন: মফস্সলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি এসব কারণেই পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়?
আনিসুজ্জামান: পিছিয়ে পড়ার নানা কারণ থাকে। ভালো শিক্ষক ও ছাত্রের অভাব তার একটা। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতাও অন্যতম কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ গবেষণায় যে ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে, তা অতুলনীয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছে।
শারফিন: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসতে চাই। বাঙালি সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য মুছে ফেলার জন্য একটি গোষ্ঠী সব সময়ই নতুন নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে আবির্ভূত হয়। এ থেকে প্রতিকারের উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
আনিসুজ্জামান: যাঁরা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বলেন, তাঁরা ১৯৭৫ সালের পরের পটভূমিতে বেড়ে ওঠা। পঁচাত্তরের পর থেকে রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা গলাগলি ধরে চলছে। যখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম এল, তখনই দৃশ্যপট বদলে গেল। রাষ্ট্রধর্ম তো আগে ছিল না। জনগণও চায়নি। ক্ষমতাবানেরা নিজেরাই বসিয়ে দিয়েছেন। পরে তা বিপুলসংখ্যক মানুষকে একমুখী করে নিল। এই সুযোগেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে অশুভ শক্তি ঢুকে পড়েছে। এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন খুব সহজ নয়। এ জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়াতে হবে সংস্কৃতিচর্চার পরিসর। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহুমাত্রিক পাঠ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য জনসম্মুখে তুলে ধরার সব রকম ব্যবস্থা থাকতে হবে।
শারফিন: কিন্তু বর্তমানে যে সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি, সেখানে বাঙালি সংস্কৃতি কতটুকু লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে?
আনিসুজ্জামান: দেখো, যতই ভিনদেশি সংস্কৃতি চেপে বসুক, বাঙালি সংস্কৃতি তাতে কোণঠাসা হয়ে পড়বে বলে মনে হয় না। হিজাব পরা মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তারাও পড়াশোনা করছে, চাকরি করছে। হিজাব তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। ১৯৪৮ সালে কোনো মেয়ে বাইরে বের হলে তাকে রিকশায় কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন ছাত্রীসংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। কোনো ছাত্রী কোনো ছাত্রের সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলবে—এমনটা ভাবাই যেত না। কথা বলতে হলে প্রক্টরের অনুমতি নিতে হতো। এখন তো আর সেই পরিবেশ নেই। মেয়েরা কত ভালো করছে। তারা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। উপার্জন করে সংসারে তো ব্যয় করছেই, নিজের শাড়ি, চুড়ি, টিপ কেনার সামর্থ্যও লাভ করেছে। হিজাব পরা অনেক মেয়ের সঙ্গেই আমি কথা বলে দেখেছি, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকীর্ণতা নেই। তারা যে শখ করে হিজাব পরে, এমনটাও নয়। বেশির ভাগই পরে পারিবারিক চাপে। যখন চাপ কেটে যায়, তখন তারা মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস ফেলে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কোনো রকম বিরূপ মনোভাব দেখিনি। রাজনীতিই সমস্যার মূলে। ধর্ম নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাই সংকটের হোতা।
শারফিন: বাংলা ভাষা সর্বস্তরে এখনো চালু হয়নি। এর পেছনে কী কারণ রয়েছে বলে মনে করেন?
আনিসুজ্জামান: এটা সম্পূর্ণ রাষ্টীয় কাজ। রাষ্ট্র চাইলেই পারে। একটি সুষ্ঠু ভাষা পরিকল্পনার আলোকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা অবশ্যই সম্ভব।
শারফিন: সামাজিক রূপান্তরের নিরিখে আজকের বাংলাদেশকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনিসুজ্জামান: সমাজের চারদিকে দুর্নীতি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। যে যেভাবে পারছে, দুর্নীতি করছে। বঙ্গবন্ধু এ ধরনের দুর্নীতিকে বলতেন, ‘ফ্রি স্টাইল দুর্নীতি’। এ ছাড়া সব সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে এখন মমতার বদলে অর্থ জায়গা করে নিয়েছে। এখন যার টাকা আছে, তার সবই আছে। কিন্তু ওই টাকার উৎস দুর্নীতিই। যদি কোনোভাবে দুর্নীতি কমিয়ে আনা যায়, তবেই একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ আমরা দেখতে পাব।
শারফিন: বলা হচ্ছে, ঢাকা বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আনিসুজ্জামান: রাজধানী কি না জানি না। আমি মনে করি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। কিন্ত এই খুশিতে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের এখনো অনেক কাজ করা বাকি। গবেষণা ও অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের আরও গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষাটা আমাদের, এই ভাষার উন্নয়নে আমাদেরই ভূমিকা রাখতে হবে।