প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে নিয়ে বই লিখতে উদ্বুদ্ধ হলেন কেন?
মালেকা বেগম: আমার জীবনে এক মহীয়সীর বিপুল প্রভাব রয়েছে—তিনি সুফিয়া কামাল। তিনিই আমার সবকিছুর প্রেরণা। আমি তাঁকে বলতাম সুফিয়া খালাম্মা। আমার অনেক কাজে যেমন খালাম্মা উৎসাহ জুগিয়েছেন, তেমনি প্রীতিলতাকে নিয়ে লেখার পেছনেও তাঁর ভূমিকা আছে। মূলত মহিলা পরিষদ করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তিনি ছিলেন আমার মেন্টর। সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে খালাম্মা একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘নারীদের আন্দোলন করা শেখাতে হবে।’ এসব কথা বলতে বলতেই বললেন, ‘যেসব নারী আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমাদের জানার চেষ্টা করতে হবে; যেমন বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মত্যাগ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।’
আমি তখন বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। চট্টগ্রামের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা জানতাম। কিন্তু সত্যি বলতে, সেভাবে বিস্তারিত জানতাম না। খালাম্মার কথা শোনার পরই অগ্নিযুগের এই বিপ্লবী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে উদ্বুদ্ধ হলাম। এ কাজে খালাম্মাও আমাকে উৎসাহ জোগালেন। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘যাঁর কথাই লিখতে যাবে, তাঁর সম্পর্কে আগে চর্চা করবে, চর্চা না করে লিখবে না।’ সুফিয়া খালাম্মার কথা আমার জন্য সব সময়ই শিরোধার্য। তবে প্রীতিলতা সম্পর্কে বিশদে জানতে গিয়ে একটু সমস্যায় পড়লাম। তখন তো বইপুস্তক এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না; বই পাওয়াও যেত কম। তো সে সময় যা পেয়েছিলাম, তা সম্বল করে প্রীতিলতাকে নিয়ে প্রথমে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। বলতে পারি, প্রবন্ধ দিয়েই আমার প্রীতিলতাচর্চার শুরু।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
মালেকা বেগম
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
দাম: ১৭০ টাকা।
ঘরে বসে বইটি পেতে অর্ডার করুন prothoma.com
প্রবন্ধটি কি ষাটের দশকেই লিখেছিলেন?
মালেকা: এত দিন পর তা আজ আর মনে নেই। মনে হয়, স্বাধীনতার পরেই লিখেছিলাম।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার শিরোনামে আপনার লেখা তাঁর জীবনীগ্রন্থটি বের হলো ২০১৮ সালে। আর আপনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন স্বাধীনতার পরে। প্রীতিলতাকে নিয়ে আপনার ভ্রমণটি বেশ দীর্ঘ। প্রবন্ধ থেকে আস্ত একটি বই—এই যাত্রা কেমন ছিল?
মালেকা: যাত্রাটা এক অর্থে আনন্দময় ছিল। আবার কষ্টকরও ছিল। আনন্দময় এই অর্থে যে প্রীতিলতা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছিলাম। আর কষ্টকর কারণ, যখন প্রীতিলতা বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করি, সে সময় তাঁর সমন্ধে বইপত্র তেমন পাওয়া যেত না, যা আগেই বলেছি। কত যে কষ্ট করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারতাম, নতুন নতুন তথ্যের আশায় পুরোনো বই ঘাঁটতাম। তারপর বিভিন্ন বইয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যেত। কোনটা ঠিক আর কোনটা অতিরঞ্জন—এসব চেক করতেও অনেক সময় যেত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি লাইব্রেরিতে কাটিয়েছি। এ সময় লাইব্রেরির কর্মকর্তারা আমাকে বলতেন, ‘আপনি এখানে কী করেন?’ বই ও তথ্যের খোঁজে ভারতেও গিয়েছি। নানাজনের সঙ্গে কথা বলেছি। ভারতের উত্তরা চক্রবর্তী, তিনি আমাকে বইপত্রের সন্ধান দিয়ে সহায়তা করেছেন। প্রীতিলতার ছোট বোন শান্তি চৌধুরী বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা নামে একটি বই লিখেছেন। ওই বই থেকেও প্রভূত সাহায্য পেয়েছি।
তা ছাড়া আমার কাজের একটি ধরন হলো, একই সঙ্গে আমি একাধিক কাজ করি; যেমন প্রীতিলতাকে নিয়ে যখন পড়ছি, তখন লীলা নাগকে নিয়েও পড়ছি। আর পড়ার সময়ে আমি একটি খাতায় নিজের মন্তব্য লিখে রাখি। এভাবে সেই ষাট দশক থেকে প্রীতিলতা বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। ষাটের দশকেই মতিউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার লেখালেখির যাত্রায় সব সময় তিনি আমাকে উৎসাহিত করেছেন। প্রীতিলতাকে নিয়ে কাজের ব্যাপারেও আমাকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। আমাকে বলতেন, ‘শুধু লিখলেই হবে না, অন্যকে তা জানাতেও হবে।’ কিন্তু আমি ভাবতাম, আগে ঠিকমতো জেনে নিই, তারপর জানাব। এই করতে করতেই বইটা বেরোতে এত দিন সময় লাগল। বই লিখতে আমার সময় লেগেছিল তিন–চার বছরের মতো।
আজও যখন মেয়েরা বিয়ে–সংসার ইত্যাদির নিগড়ে আবদ্ধ, তখন সেই ব্রিটিশ আমলে আমাদের পূর্ববঙ্গের একজন মেয়ে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে কীভাবে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, সবাইকে তা জানানো নিজের দায়িত্ব বলে মনে হলো।
শেষাবধি বইটি কেন লিখলেন?
মালেকা: আসলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সম্পর্কে জানতে গিয়ে প্রতিনিয়তই বিস্মিত হয়েছি। তাঁর বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির হেডক্লার্ক ও গৃহশিক্ষক। পরের দিকে প্রীতিলতার উপার্জন তাঁদের সংসারের একটা বড় অবলম্বন ছিল। কিন্তু নিজের মা–বাবা, পরিজনের চিন্তা না করে দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি যে আত্মাহুতি দিলেন, অনেক বড় ব্যাপার না এটা?
বইটা আমি লিখলাম কারণ, মনে হলো, প্রীতিলতার যে বিপ্লবী জীবন, সেটি মানুষকে জানানো দরকার। আজও যখন মেয়েরা বিয়ে–সংসার ইত্যাদির নিগড়ে আবদ্ধ, লেখাপড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এমনকি মায়েরাও যখন তাঁদের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে যান, ক্ষণে ক্ষণে পিছুটান যখন নারীর পথ রোধ করতে উদ্যত, তখন সেই ব্রিটিশ আমলে আমাদের পূর্ববঙ্গের একজন মেয়ে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে কীভাবে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, সবাইকে তা জানানো নিজের দায়িত্ব বলে মনে হলো। মনে হলো, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আমাদের আজকের যুগের নারীর জন্যও বড় অনুপ্রেরণা হতে পারেন। তাই বইটি আমি সহজ ভাষায় লিখতে চেষ্টা করেছি, যাতে সব বয়সের পাঠক এই বিপ্লবী নারীর জীবন সম্পর্কে জানতে পারেন।
দীর্ঘদিন প্রীতিলতাচর্চার পর আপনার উপলব্ধি কী?
মালেকা: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নিয়ে জানতে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, নিজেকে ধিক্কার দিই। মনে হয়েছে, কী রাজনীতি করলাম, কী বিপ্লব করলাম। সত্যিকারের বিপ্লবী তো প্রীতিলতাই। এখন এই সময়ের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা যদি প্রীতিলতার জীবন ও দর্শনকে বুঝতে পারি, তিনি যে নিপীড়িত মানুষের জন্য জীবন দিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যদি দাঁড়াতে পারি, তবেই তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে আমি মনে করি।