রক্তে লেখা পঙ্‌ক্তিমালা

ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল কবিতা, গান, র‌্যাপ, পোস্টার, কার্টুন আর গ্রাফিতি। এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ভাষায় ধরা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে সচিত্র দলিল বিদ্রোহে–বিপ্লবে

গণ–অভ্যুত্থানের উত্থান–পতনময় সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবিতা লিখে একাত্ম হয়েছিলেন কবিরা। রক্তে লেখা সেসব কবিতা

রওশন আরা মুক্তা

গোল্ডফিশের কান্না

উৎসর্গ: শহীদ আবু সাঈদ 

একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য

তোমার ছেলের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি।

একটা ওভারব্রিজের দাম

তোমার হাজার ছেলের লাশ দিয়েও কি চুকাতে পারবে?

একটা মেট্রোস্টেশন কি গর্ভে ধরতে পারবে তুমি?

কী আছে তোমার অপত্যস্নেহে?

গাড়িগুলো বাসগুলো যে পুড়ে গেল

তোমার ছেলেদের রক্তমাংসে তো আর

চলবে না এদের ইঞ্জিন!

মেট্রো কি আর তোমার ছেলেদের

দুঃসাহসের বিদ্যুতে ছুটবে?

বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল কি

তোমার জানাজার কান্নায় আদায় হবে?

কী করে জন্ম দিলে এমন সন্তান?

ভয় পায় না দিতে জান!

যেদিন তোমার পেটে ধরতে পারবে

আস্ত একটা মেট্রোরেল,

যেদিন তোমাদের কোলে দোলাতে পারবে

একটা গোটা দেশের ডেটাসেন্টার

যেদিন তোমার স্তন থেকে দুধ না

ঝরবে বিটিভির বাম্পার ফলনের সংবাদ

যেদিন তোমরা মানুষের বাচ্চা না,

জন্ম দেবে বাস-ট্রাক, ওভারব্রিজ!

সেদিন বুঝতে পারবে,

একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য

তোমার রক্ত-মাংসের সন্তানের চেয়ে

আসলেই অনেক বেশি।

তখন চুমু খেয়ো ওই ইট সিমেন্টের শরীরে

গাড়িগুলোকে পাশে শুইয়ে দিয়ো হাত বুলিয়ে।

পদ্মা সেতুটাকে পাঠিয়ো ভার্সিটিতে,

পাবলিকে না হয় প্রাইভেটে—

আর রাতে ঘরে ফেরার অপেক্ষা করো

প্রিয় ওভারব্রিজটার, স্টেশনটার।

মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিয়ো বিটিভিকে।

‘বাবা’ বলে ডেকো শখের মেট্রোরেলকে।

আর ভুলে যেয়ো, সব ভুলে যেয়ো।

রক্তমাংসের কোনো ছেলে ছিল তোমার

পেটে ছিল, পিঠে ছিল, কোলে ছিল!

ভুলে যেয়ো, তুচ্ছ নগণ্য ওই মনুষ্য–সন্তান

কখনো তোমাকে মা ডেকেছিল!

তোমার ঘরে এখন বিটিভি,

তোমার বিছানায় এক্সপ্রেসওয়ে

তোমার আঁচল ধরে আছে মেট্রোরেল

আর কী চাই তোমার?

যাও চুমু খেয়ে নাও ভবনটাকে, চেয়ারটাকে, হেলিকপ্টারটাকে!

তারপর ঘুমিয়ে যাও—

সকালে আবার তোমার বিল্ডিংগুলোর ক্লাস আছে।

২৪ জুলাই ২০২৪

খুলনার খালিশপুরে
ছবি: প্রথম আলো

মীর হাবীব আল মানজুর

হাশরের ময়দান

সিনামায় বহুত দেখছি তো,

তাই মনটন খারাপ হয় না

এমনই হয় নাকি জালেম?

যার পিপাসা কোনো দিনই মেটে না!

শহীদের সিম্বল শুধু রক্ত,

তার কোনো ভাববাদ নাই,

সে স্পষ্ট ও তেজের ফলা,

সে আমাদের বীর,

আমাদের ধমনিতে সাহসের চালক

তুমি আমি বহু কিছু দেখি,

হাত মুঠবদ্ধ হয়া যায়,

আমরা মানুষ তাই মুখ থেকে শব্দ বাইর হয়,

ভীরুতা আমাদের জন্য শুধু ডরপুক শব্দটা রাইখা যায়

আমাদের মারতে চায় কারা, তোমরা জানো

ওপর থেকে গড়গড় শব্দে আতঙ্ক ছড়ায়,

আমাদের বহু মানুষ চোখ হারায়া ফেলে,

আমাদের পায়ে ঢুইকা পড়ে বুলেট,

আমাদের শ্বাসনালি রক্তের কাছে অসহায় হয়া যায়

কোথাও ছবি নাই এমন একজন মর্গে পইড়া আছে,

নামফলক ছাড়া একটা কবরের মাটি সমান হয়া গেল,

বারান্দায় দাঁড়ায়া কারও হাত ফুটা হয়া গেল,

একজন দিনমজুর ঘরে ফিরতে যায়া অ্যাম্বুলেন্স দিয়া কই চইলা গেল?

আমরা জইমা গেছি, কী করব কিছুই জানি না

আমরা একটা পাহাড়ের গিরিখাতে আলাদা হয়া পড়ছি,

আমরা অনেক মানুষ অথচ এক এক হয়া ধরা পড়ছি,

জালেম জানে, আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যোগাযোগ

কী করব মানুষের জন্য? কিছুই জানি না

চোখে পানি, আমাদের ভিতরে ভয়

আর জালেমরে চোখ রাঙানোর একটা মওকা খোঁজার পাঁয়তারা,

রাত আসলেই হতাশ হয়া পড়ি,

দিন হলে মনে হয় একত্র হব আমরা সবাই,

হাশরের ময়দান বসছে,

জালেম জালেম বলে একটা গাছ কুঠার দিয়া হাজার টুকরা করে ফেলতেছি

২৪ জুলাই ২০২৪

ময়মনসিংহের মুমিনুন্নেসা মহিলা কলেজের দেয়ালে চিত্রিত আবু সাঈদ
ছবি: প্রথম আলো

অরিন্দম পাল ঝিনুক

যে জানালা দিয়ে দেশ দেখা যায় না

জানালার গ্রিলের ফাঁকে

যে শহরটাকে দেখছিলেন,

একদিন সেখানে ফুটত

কদম-কামিনী-কেয়া-কৃষ্ণচূড়া।

আজ শ্রবণা নক্ষত্রে

সেখানে বুলেট ঝাঁঝরা করা বুকে

বাজছে সত্যশব্দের কবিতা।

ফুলেল শবেরা ঠায় দাঁড়িয়ে—

সাক্ষ্য দিচ্ছে হন্তারকের নির্মমতার।

মিছিল-স্লোগানের অভ্যর্থনায়

নামা ক্ষুধার্ত রাইফেল-কামান-গোলাবারুদ

রক্তাক্ত বাগানে যখন মাটি শুষে নিচ্ছে তীব্র বিষাদ,

ঠিক তখনই আপনি দিচ্ছেন চুমুক পেয়ালায়

পান করছিলেন লাল টুকটুকে স্ট্রবেরির জুস।

আপনার শ্রাবণবেলার আয়েশি সন্ধ্যাকালে

নির্জন শহরের পথে-পথে রক্তিম প্লাবনে

দূর থেকে ভেসে আসে ঝরে যাওয়া

শ্রাবণফুলের ঘ্রাণ

সাঈদ-শান্ত-ওয়াসিম-তামিমসহ আরও কতশত...

ইতিহাস রেখেছে বুকে, সেই সব নাম!

কোনো এক শ্রাবণ পূর্ণিমায়

হয়তো বদলে যাবে সবই...

শুধু থেকে যাবে একটা আফসোস—

‘আপনার জানালা দিয়ে সেদিন

দেশটা দেখেননি

দেখেননি মানুষ 

দেখেছিলেন শুধু দালান-ইমারত-উড়ালসেতু আর মেট্রোরেল স্টেশন।’

২৭ জুলাই ২০২৪

মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

রিশি কাব্য

মাথার মধ্যে দেশ, বুকের মধ্যে প্রেমিকা

এই শহরে পাখিদের ঘুম ভাঙে গুলির শব্দে

এই শহরে ছাত্র পড়ে থাকে মগজভর্তি বারুদের গন্ধে

মস্তিষ্ক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে শকুনের গুলি

রক্তের দাবানলে ভেসে যাচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা

ফ্যাসিস্ট কারা? স্বৈরাচার কে?

শকুনের ভয়ে থাকে ঘরে কে?

মায়ের বুকের আর্তনাদ—

হামার বেটাকে মারলু কেন?

তৃষ্ণার্ত কালো র‌্যাব,

পানি লাগবে আর কারও?

শহর যখন নির্ঘুম মুগ্ধ, প্রিয়, সাঈদের রক্তে,

তখন বেওয়ারিশ লাশেদের দ্বন্দ্বে কোথাও কেউ নেই।

কাঁটাতার ফেলে আসা খাকি হায়েনার শব্দ–বোমায়

ঢেকে যাচ্ছে মুক্তির স্লোগান

টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় নিখোঁজ হচ্ছে লাশ

প্লেনের শব্দের পিছু নিয়ে মাইল পাড়ি দেওয়া থেকে

হেলিকপ্টারের শব্দে আতঙ্ক লাগার সময়ে আজ

এই শহরে পাখিদের ঘুম ভাঙে গুলির শব্দে

এই শহর নেশায় বুঁদ বারুদের গন্ধে।

২৯ জুলাই ২০২৪

রুম্মানা জান্নাত

মেমোরিজ অব থার্টি থার্ড জুলাই

দেশ যদি স্বাধীন হয়, যদি কখনো আবার আনন্দের দিন আসে জীবনে, যদি আমার ব্যক্তিগত সাফল্যের উপলক্ষ আসে, কোনো অর্জন, এক বেলায় ভালো খেতে পারার মতো সুখের দিন যদি আসে আবার, আমি প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের এই রক্তের দিনগুলো মনে করব—প্রতিটা মুখ! আমি নিজেকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেব কীভাবে আমার ভাইয়েরা জালিমের বন্দুকের সামনে তাদের সচ্ছল তাজা জীবন পেতে দিল, কীভাবে আমার বোনদের রক্ত গড়াল, আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেব কীভাবে ঘরে ঢুকে আমাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে—বিছানায়, জানালায় এমনকি বাবার কোলে কীভাবে লুটিয়ে পড়ল আমাদের দুধমাখা শিশু!

আমি যদি লিখি আর আমার কবিতায়, ভাষায়, আমার সাহিত্যে আমার ভাইদের রক্তের উষ্ণতা থাকবে, আমার বোনদের বিদ্রোহের রং আর আমার সন্তানদের বেহেশতি খুশবু থাকবে।

আমি আমার মগজকে শাণিত করব। প্র্যাকটিস করব প্রতিদিন। কিন্তু আমি আমাকে কখনোই ভুলতে দেব না এই অশান্তির রাতগুলো কীভাবে আমরা জানালার শিক ধরে কাটিয়েছি, আমরা গোল হয়ে বসে থেকেছি, কান পেতে থেকেছি স্বৈরাচারীর পতনের দিকে। আমি বারবার নিজেরে মনে করিয়ে দেব কীভাবে আমাদের মানুষগুলার চোখে অন্ধত্ব দিয়েছে জালিমেরা, যেন তারা স্বাধীনতার একটা আলোকরশ্মিও দেখতে না পায়! কিন্তু আমরা তাদের চোখে মুক্তির রোশনাই এনে দেব।

আমার নিজের সাথে ওয়াদা—আমার যেকোনো আনন্দে, আমার প্রতিটা বেদনায় আমি আমারে মনে করিয়ে দেব আমরা এই সবুজ দিনগুলো কীভাবে পেয়েছি! আমি আমাকে কখনোই ভুলতে দেব না। আমি আমাকে কোনো দিন ভুলতে দেব না কোনো মুখ!

৩১ জুলাই ২০২৪

কাজী ওয়ালী উল্লাহ

মার্চ টু ঢাকা

এই অন্ধকারে যারা বের হয়ে পড়ছে

তাদের জামার ভিতর আজ লুকানো আলো

দীর্ঘ সফরের পর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, নবীনগর, আমিনবাজারের মোড়গুলাতে দাঁড়ায়ে

তারা কাপড় ঝাড়া দিবে

আর ঢাকায় সকাল হবে

এখনো যে মোহররম হয় নাই শেষ

এখনো যে জুলাই চলমান

এই তো তাদের মর্যাদা

তাদের অন্তরে প্রকাশ হয়ে আছে কারবালার গোপন বিজয়

তাদের হাতের বাঁশগুলা তিতুমীরের দুর্গ থেকে খুলে আনা

ঢাকার বুকে যে দুধ জমা হয়ে আছে

কাল তারা তা শিশুর মতো পান করবে

আর ঢাকাকে স্বাদ দিবে নতুন মাতৃত্বের

৪ আগস্ট ২০২৪