ইয়োন ফসে: একালের ইবসেন
গতকাল ৫ অক্টোবর ঘোষণা হয়েছে সাহিত্যে নোবেল। এ বছর পুরস্কারটি পেয়েছেন নরওয়ের নাট্যকার ইয়োন ফসে
সাহিত্যের সবচেয়ে আরাধ্য আর সম্মানজনক স্বীকৃতি হলো নোবেল পুরস্কার। ২০২৩ সালে পুরস্কারটি পেয়েছেন নরওয়ের নাট্যকার ইয়োন ফসে। ১৯৫৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নরওয়ের পশ্চিম উপকূলের হাউজেসুন্ডে জন্ম নেওয়া এই লেখক মূলত নরওয়ের নিনোরস্ক ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। নাট্যকার হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও ইয়োন ফসের আগ্রহের গণ্ডি থেকে বাদ পড়েনি উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুতোষ রচনা ও অনুবাদ। নিজের রচিত গীতের ওপর সুরারোপও করে থাকেন তিনি। বর্তমান বিশ্বে জীবিত নাট্যকারদের মধ্যে যাঁদের নাটক সবচেয়ে বেশি মঞ্চস্থ হয়, ফসে তাঁদের একজন।
ইয়োন ফসের প্রথম উপন্যাসে ছিল অপরিণত আবেগ আর বিদ্রোহের ঘনঘটা, যা তাঁর পরবর্তী কাজের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। ভাষা ও নাটকীয়তা আমূল কমিয়ে মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী মানবিক আবেগ, উদ্বেগ ও অসহায়ত্বকে দৈনন্দিনতার সহজ ভাষায় মেলে ধরেন তিনি। বলা ভালো, এই ক্ষমতার মাধ্যমে পরাজিত মানুষের অভিযোজনসক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। বিপরীতভাবে তা ব্যক্তিকে এক গভীর স্বর্গীয় অভিজ্ঞতারও সন্ধান দেয়। নাটকে ফসের এই অভিব্যক্তি কিংবা কৌশল, যা–ই বলি না কেন, তা তাঁকে সমকালীন থিয়েটারে একজন গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবকের মর্যাদা দিয়েছে।
নিনোরস্ক সাহিত্যে ইয়োন ফসের মহান পূর্বসূরি তারজেই ভেসাসের মতোই তিনি আধুনিক শৈল্পিক কলাকৌশলের সঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক এবং ভূগোলের শক্তিশালী স্থানিক বন্ধন নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর তাঁর প্রেরণার জায়গায় রয়েছেন স্যামুয়েল বেকেট, থমাস বার্নহার্ড, জর্জ ট্রাকলসহ অনেকেই। তবে এতে করে ইয়োন ফসের জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রকাশকে পৃথিবীর প্রতি অনির্দিষ্ট শূন্যতার আধার হিসেবে নিশ্চিত করা ঠিক হবে না। উল্টো তাঁর রচনায় পাওয়া যায় বিপুল উষ্ণতা ও হাস্যরস। মানুষের অভিজ্ঞতার প্রতি অবোধ পক্ষপাতের ছবিই বরং প্রতিভাত হয় তাঁর লেখায়।
নাট্যকার হিসেবে ১৯৯৯ সালে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে প্রথম নিজেকে তুলে ধরেন ইয়োন ফসে, প্যারিসে তাঁর লেখা নোকন কেজেম টিল আ কোমে (ইংরেজিতে যার অর্থ ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’) মঞ্চায়নের মাধ্যমে।
ইয়োন ফসে গত শতকের নব্বই দশকে নরওয়েতে কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে ১৯৯২ সালে যখন তিনি নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন, তখন থেকেই তাঁর লেখকজীবনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। নরওয়ের একটি স্থানীয় নাট্যদল তাঁকে একটি নাটক লেখার আমন্ত্রণ জানালে সেটিকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। আর এর ফলাফলও ছিল বিস্ময়কর। কয়েক বছরের মধ্যেই ফসের নাটক ইউরোপজুড়ে মঞ্চস্থ হতে থাকে। নরওয়ের বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের পর তাঁর নাটকই সর্বাধিক মঞ্চায়িত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। তাই অনেকেই তাঁকে ‘নয়া ইবসেন’, আবার কেউ কেউ ‘একবিংশ শতকের বেকেট’ বলেও অভিহিত করে থাকেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাট্যকার হিসেবে দ্রুতই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ফসের। এখন পর্যন্ত তিনি ২৬টি নাটক লিখেছেন। বই প্রকাশ পেয়েছে ৩০টির মতো। বিশ্বের ৪০–এর বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর রচনা। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর করা বিশ্বের জীবিত শত প্রতিভাধরের তালিকায় তাঁর নাম আছে ৮৩ নম্বরে। ইয়োন ফসের নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম হোম, অ্যান্ড উই উইল নেভার বি পার্টেড, দ্য নেম, দ্য চাইল্ড, মাদার অ্যান্ড চাইল্ড, দ্য সন, দ্য গিটার ম্যান, আ সামারস ডে, ড্রিম অব আঁম, স্লিপ মাই বেবি স্লিপ, শ্যাডোস, উইন্টার, বিউটিফুল ইত্যাদি।
নাট্যকার হিসেবে বর্তমান বিশ্বে ইয়োন ফসে কেন গুরুত্বপূর্ণ? প্রশ্নের উত্তরে বলা যাবে, তাঁর নাটকে যেমন আধ্যাত্মবাদ রয়েছে, তেমনি আছে হাস্যরসমিশ্রিত কঠোর বাস্তবতাও। দৈনন্দিন ভাষার মধ্য দিয়ে তিনি সেই গহন কথাই বলে ফেলেন, মানুষ যা বলতে ভয় পায়। এসব বৈশিষ্ট্য তাঁর স্বদেশি নাট্যকার হেনরিক ইবসেনেরও ছিল। নরওয়ের এই নাট্যকার একািধকবার েনাবেল পুরস্কােরর জন৵ মনোনয়ন পেলেও নোবেল পাননি। এবার ইয়োন ফসেকে পুরস্কারটি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই খামতিই কি মোচনের চেষ্টা করল সুইডিশ একাডেমি?