কেমন ছিল ফ্রিদা কাহলোর জগৎ, কেমন ছিল ফ্রিদা-দিয়েগোর সম্পর্ক

আজ বিশ্বখ্যাত চিত্রকর ফ্রিদা কাহলোর জন্মদিন। ছবি, জীবনযাপন, প্রেম—সব মিলিয়ে শিল্পানুরাগীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছেন তিনি।

ফ্যাশন সচেতন শিল্পী ফ্রিদা কাহলোছবি: এএফপি

আমার জীবনে বড় দুর্ঘটনা এসেছে দুবার, ফ্রিদা কাহলো তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘একটি হলো ট্রলি, আরেকটি দিয়েগো। এই দুয়ের মধ্যে এখনো দিয়েগোই সবচেয়ে ভয়ানক।’

চিত্রকলার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী শিল্পী হলেন ফ্রিদা কাহলো। মেক্সিকোর আধুনিক শিল্পগাথার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তিনি।

১৯০৭ সালের ৬ জুলাই যখন ফ্রিদা কাহলোর জন্ম হয়, তখন তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই কালদেরন। পরে অবশ্য তিনি নিজেই নিজের নাম সংক্ষিপ্ত করে রেখেছিলেন ফ্রিদা কাহলো। ফ্রিদা চাইতেন সবাই জানুক তাঁর জন্ম হয় ১৯০৭ সালে নয়, বরং ১৯১০ সালের ৬ জুলাই। ১৯১০ সালের ম্যাক্সিকান বিপ্লবের সঙ্গেই সবাই যেন তাঁকে মনে করতে পারে, এটা ভেবেই তাঁর এই চাওয়া। রাজনৈতিক যে অস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র অভিমুখী এক রাজনৈতিক যাত্রায় অগ্রসর হচ্ছিল মেক্সিকো, তার সঙ্গে একাত্ম ছিলেন তিনিও। বয়স বাড়লে হয়েছিলেন মার্ক্সিস্ট।

নারীবাদী চিত্রকর হিসেবে তিনি যেকোনো তাত্ত্বিক নারীবাদীর থেকেও প্রভাবশালী এবং সর্বজননন্দিত। তবে ফ্রিদা কাহলোর জীবন অবর্ণনীয় কষ্টের এক মহাকাব্যও যেন।
ফ্রিদার যখন ছয় বছর বয়সে, তখন পোলিওয় স্থায়ীভাবে তাঁর ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় ফ্রিদার বাস একটি স্ট্রিটকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল। সে দুর্ঘটনায় তিনি ভয়ানকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন—তাঁর মেরুদণ্ড বেশ কয়েকটি জায়গায় ভেঙে গিয়েছিল এবং পিঠ, পাঁজর, কলার বোন, বাঁ কাঁধ ও ডান পা সবই ভেঙে গিয়েছিল।

একটি ধাতব রড ফ্রিদা কাহলোর শ্রোণিচক্র ভেঙে ফেলে, ছিদ্র করে তাঁর পেট ও গর্ভ। হাসপাতালে থাকাকালে ফ্রিদা জানতে পেরেছিলেন যে তিনি কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবেন না।

ফ্রিদার জীবদ্দশায় ৩০টির বেশি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল এবং ভুগতে হয়েছে আমৃত্যু। বিছানায় শুয়ে স্বাস্থ্যের ধীর পুনরুদ্ধারের সময় ফ্রিদার বাবা তাঁর বিছানায় একটি বিশেষ ইজেল সংযুক্ত করেছিলেন, যাতে ফ্রিদা ছবি এঁকে নিজের মনকে কিছুটা শান্ত করতে পারেন। ফ্রিদা তখন নিজেকে আঁকতে শিখিয়েছিলেন এবং প্রায়ই ওল্ড মাস্টারদের শিল্প নিজের মতো করে অধ্যয়ন করতেন।

ফ্রিদার সঙ্গে দিয়েগোর প্রথম দেখা ১৯২২ সালে। দিয়েগো রিভেরা তখন মেক্সিকোর বিখ্যাত ন্যাশনাল প্রিপারেটরি স্কুলের সিনিয়র হাইস্কুলের সিমন বলিভার অ্যাম্ফিথিয়েটারে ম্যুরাল ‘লা ক্রেয়াসিয়ন’ আঁকছিলেন। দিয়েগোর আঁকাআঁকির মধ্যেই চঞ্চল ফ্রিদা প্রায়ই তাঁকে জ্বালাতেন, খুঁচিয়ে মশকরা করতেন দিয়েগোর সঙ্গে নানাভাবে।

১৫ বছরের ফ্রিদা সে সময়ই কিছুটা প্রেমে পড়েন ক্যারিশম্যাটিক এবং নারীপ্রিয় দিয়েগোর প্রতি—এমনকি তিনি তাঁর বন্ধুদের এ-ও নাকি বলেছিলেন যে তিনি একদিন দিয়েগোর সন্তানের মা হবেন। আর দিয়েগোও তখনই ফ্রিদার মধ্যে দেখেছিলেন ‘চমৎকার আত্মমর্যাদা, একটা ভীষণ আত্মনিশ্চয়তা এবং চোখে অদ্ভুত এক আগুন’।

ফ্রিদার বন্ধু এবং দিয়েগোর সাবেক প্রেমিকা ইতালির আলোকচিত্রী টিনা মোডোত্তির আয়োজিত একটি পার্টিতে নাকি তাঁদের দুজনের আবার দেখা হয়—এমনটা লোকে বলে। তবে তাঁর স্মৃতিকথায় দিয়েগো লিখেছিলেন, ফ্রিদার সঙ্গে তাঁর আবার দেখা হয়, যখন ফ্রিদা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তাঁর আঁকা দেখতে থাকেন। যদিও তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি যে এই সেই মেয়ে, যিনি অনেক বছর আগে তাঁকে জ্বালাতন করেছিলেন।

দিয়েগো ও ফ্রিদা

একদিন ফ্রিদা দিয়েগোকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং ফ্রিদার কাজের একটা অকপট সত্য সমালোচনা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। দিয়েগো তাঁকে বলেছিল, ‘আমার মতে, যতই বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, তোমার ছবি আঁকা থামা চলবে না।’

দিয়েগো রিভেরা যখন ফ্রিদা কাহলোকে বিয়ে করেন, তখন ফ্রিদার বাবা মজা করে বলেছিলেন, এটা হলো ‘হাতি ও পায়রার মিলন’।

দিয়েগো ফ্রিদার চেয়ে ২০ বছরের বড় এবং তত দিনে তিনি মেক্সিকোর উদীয়মান আধুনিক শিল্পের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। লম্বায় যে দিয়েগো ছয় ফুট এবং গড়নেও বিশাল, সে বিষয়ও ভুললে চলবে না।

অন্যদিকে ফ্রিদা ছোটখাটো, ২২ বছরের তরুণী। কিছুদিন আগেই তিনি উঠে এসেছেন সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা থেকে, যা তাঁর জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল।

‘আমি তখনো জানতাম না, তবে ফ্রিদা ইতিমধ্যে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল এবং আমৃত্যু তাই-ই ছিল।’ দিয়েগো ফ্রিদাকে নিয়ে এমনটাই ভাবতেন।

দিয়েগো বর্ণনা করেছেন, ফ্রিদার বাড়ি ‘কাসা আজুলে’ নিজ ঘরে ফ্রিদা তাঁর আঁকা ছবিগুলোর সামনে কীভাবে ‘প্যারেড’ করেছিলেন আর দিয়েগোর আত্মা ভরে উঠেছিল এক বিস্ময়কর আনন্দে।

পরবর্তীকালে দিয়েগো স্মরণ করেছিলেন, তিনি ঠিক তখনই বুঝেছে গিয়েছিলেন, ‘এই নারীই’ তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলবেন আজীবন।

ফ্রিদার মা মনে করতেন, দিয়েগো ফ্রিদার জন্য অনুপযুক্ত। ফ্রিদার বাবা দিয়েগোকে সতর্ক করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাঁর প্রিয় কন্যা একটি ‘সাক্ষাৎ শয়তান’। স্পষ্টতই উভয়ের কেউই এসব সতর্কবাণীর তোয়াক্কা করেনি।
১৯২৯ সালে ফ্রিদা ও দিয়েগো বিয়ে করেন। উদ্ভট এই জুটি বিশ্বকে মুগ্ধ করেছিল এবং তাঁদের ছিল শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অস্থিতিশীল সম্পর্কগুলোর একটি। তাঁদের মোহ, আবেগ ও ভক্তি মিলেমিশে একাকার হয় অপরের প্রতি ঈর্ষা, রাগ ও বিশ্বাসঘাতকতায়। তাঁরা দুজনেই বিবাহবহির্ভূত বহু সম্পর্ক করেছিলেন।

দিয়েগো মেক্সিকোর স্থানীয় ম্যুরাল ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং ফ্রিদা একটি নতুন নির্ভীক আত্মপ্রতিকৃতি আঁকার পথপ্রদর্শক হয়েছেন।

দিয়েগো বহু প্রেমে মগ্ন ছিলেন, ফ্রিদাও একইভাবে ছিলেন—পুরুষ ও নারী উভয়ের সঙ্গেই। কিন্তু ফ্রিদার প্রিয় বোন ক্রিস্টিনার সঙ্গে দিয়েগোর একটি সম্পর্ক হয়, যা ফ্রিদা মেনে নিতে পারেননি। ফ্রিদা বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং দিয়েগো ডিভোর্সের কার্যক্রম শুরু করেন।

ফ্রিদার জীবনে দিয়েগো রিভেরা একটি অবিচ্ছেদ্য নাম। তাঁর চিত্রকলা ও ব্যক্তিগত সব নির্যাসে দিয়েগো রিভেরা ছিলেন। বিপ্লবোত্তর মেক্সিকোয় পুরুষ-অধ্যুষিত পরিবেশে ফ্রিদা হয়ে উঠেছিলেন নারীবাদী আইকন, যিনি সব সামাজিক নিয়ম ভেঙে দিয়েছিলেন এবং বিশ শতকের কিছু মর্মস্পর্শী পেইন্টিং তৈরি করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে ফ্রিদা কাহলোর কর্মজীবন যতটা উন্নত ছিল, ঠিক ততটাই ভেঙে পড়ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। ১৯৩৯ সালে ফ্রিদা তিন মাস মেক্সিকো এবং দিয়েগো থেকে দূরে ছিলেন।

নিউইয়র্কে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী ছিল, যা বিশাল সাফল্য অর্জন করেছিল। হলিউড অভিনেতা এডওয়ার্ড জি. রবিনসন তাঁর চারটি কাজ কিনেছিলেন। সেই বছর পরে তিনি প্যারিসে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন, আবারও একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছিল, এবার লুভর তাঁর একটি কাজ কিনেছিল। সুররিয়ালিস্টদের নেতা আন্দ্রে ব্রেটন তাঁর চিত্রকর্মগুলো ‘একেকটি বোমা, যেন রঙিন ফিতে দিয়ে বাঁধা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ফ্রিদা তখন প্যারিসে একজন বিশাল সেলিব্রিটি।

ফ্রিদা ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে মেক্সিকোয় ফিরে আসেন একজন ভিন্ন নারী হিসেবে। ৩২ বছর বয়সে তিনি অ্যাভান্ট-গার্ড শিল্পের বিশ্বের সেরা শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন, যিনি তাঁর বিখ্যাত স্বামীর সহায়তা ছাড়াই সফল হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দূরে থাকাকালে দিয়েগোও নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করেছিলেন এবং দুজনের সম্পর্ক ভেঙে পড়তে শুরু করে। দিয়েগো বহু প্রেমে মগ্ন ছিলেন, ফ্রিদাও একইভাবে ছিলেন—পুরুষ ও নারী উভয়ের সঙ্গেই। কিন্তু ফ্রিদার প্রিয় বোন ক্রিস্টিনার সঙ্গে দিয়েগোর একটি সম্পর্ক হয়, যা ফ্রিদা মেনে নিতে পারেননি। ফ্রিদা বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং দিয়েগো ডিভোর্সের কার্যক্রম শুরু করেন। যদিও এক বছর পর তাঁরা আবারও বিয়ে করেন। এক অপরকে তাঁরা কখনোই ছেড়ে থাকতে পারেননি।
ফ্রিদা তখন বিমর্ষ। তিনি চুল কেটে ফেলেন এবং দিয়েগো যে ম্যাক্সিকান পোশাকগুলো পছন্দ করতেন, তা পরা বন্ধ করে দেন।

এই নাটকীয় পরিস্থিতিতে ফ্রিদা ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ আঁকতে শুরু করেন। ফ্রিদা বলেন, এই ছবি হলো ‘দিয়েগো যে ফ্রিদাকে ভালোবাসতেন এবং যাঁকে তিনি ভালোবাসেননি।’

ফ্রিদা কাহলো ,ফ্রিদা ছবির পোস্টার

ফ্রিদা কাহলোর প্রায় ২০০ চিত্রকর্মের মধ্যে ৫৫টি আত্মপ্রতিকৃতি। ১৮ বছর বয়সে দুর্ঘটনার পর তিনি একটি বছর বিছানায় কাটিয়েছিলেন। তাঁর বাবা তাঁকে রং দিয়েছিলেন এবং তাঁর মা একটি বিশেষ স্ট্যান্ড তৈরি করেছিলেন, যাতে তিনি হাসপাতালের বিছানায় বসে আঁকতে পারেন এবং তাঁর ওপরে একটি আয়না লাগিয়েছিলেন, যাতে তিনি নিজেকে আঁকতে পারেন। এমন একজনের জন্য যাঁর এত সীমাবদ্ধতা ছিল, সে কারণে নিজেকে আঁকা একটি সুবিধাজনক বিষয় ছিল। ফ্রিদার বেশির ভাগ চিত্রকর্ম ছোট ছিল, কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো এগুলো অনেকগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়ে আঁকা হয়েছিল। ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ একটি ব্যতিক্রম। এটি বর্গাকার। ১ দশমিক ৭৩ বাই ১ দশমিক ৭৩ মিটার। এটি প্রায় জীবনের আকারের এবং ফ্রিদার বৃহত্তম চিত্রকর্ম ছিল। পরিবর্তনের পেছনে প্রকৃতপক্ষে একটি বাণিজ্যিক কারণ রয়েছে। যেহেতু তিনি অনেক স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন এবং তাঁকে বিভিন্ন মানুষ পরামর্শ দিচ্ছিল যে বড় ক্যানভাসগুলো ‘আরও বাণিজ্যিক’।

‘দ্য টু ফ্রিদাস’-এ ডান দিকে গাঢ় ত্বকের ফ্রিদা হলেন দেশীয় মেক্সিকান ফ্রিদা, যাঁকে তাঁর স্বামী পছন্দ করতেন এবং বাঁ দিকে হালকা ত্বকের ফ্রিদা হলেন ইউরোপীয় ফ্রিদা, যাঁকে দিয়েগো প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মেক্সিকান ফ্রিদা ঐতিহ্যবাহী ‘তেহুয়ানা’ পোশাক পরা। দেশীয় তেহুয়ানা, একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, মেক্সিকান বিপ্লবীদের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তিনি যেভাবে পোশাক পরেছিলেন, তা সাংস্কৃতিক পরিচয়, জাতীয়তাবাদ এবং নারীবাদের একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছিল। তবে তেহুয়ানা স্কার্ট, বাক্সযুক্ত ব্লাউজ, উচ্ছ্বসিত চুলের স্টাইল এবং মুখের চুলগুলোর আরও একটি বাস্তব উদ্দেশ্য ছিল...একটি ছদ্মবেশ। তাঁর মাথা ও কাঁধের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে তিনি তাঁর পোলিও আক্রান্ত পা থেকে দর্শকের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। ডান পা লুকানোর জন্য তিনি শিশুকাল থেকেই লম্বা স্কার্ট পরা শুরু করেছিলেন। ঢোলা পোশাক তাঁর খুঁড়িয়ে হাঁটা লুকিয়ে রাখত।

বাস দুর্ঘটনার পরে তাঁকে মারাত্মক মেরুদণ্ডের আঘাতের কারণে মেডিকেল কর্সেট পরতে হয়েছিল। তাঁর জীবদ্দশায় ৩০টিরও বেশি প্রধান অপারেশন হয়েছিল—১৯৫৩ সালে, তাঁর ডান পা কেটে ফেলাসহ। তিনি একটি মেডিকেল কর্সেট বা একটি প্লাস্টার কাস্টের ওপর আলগাভাবে ফেলার জন্য ‘হুইপিল’ নামক বিনা সংযুক্তিসহ একটি স্লিভলেস ব্লাউজও পরতেন। ২০০৪ সালে কাসা আজুল, ফ্রিদার বাড়িতে একটি পোশাকের পেছনে একটি ছোট ড্রয়িং পাওয়া গেছে। এটি চারকোল এবং ক্রেয়নে একটি আত্মপ্রতিকৃতি, যেখানে একটি স্বচ্ছ পোশাকের নিচে ফ্রিদার ভাঙা শরীর দেখায়।

অঙ্কনের নিচে তিনি স্প্যানিশ ভাষায় লিখেছেন, ‘যা দেখছ, তা নয়’। তবু ফ্রিদা তাঁর বিয়ের দিন ১৯২৯ সালে পর্যন্ত দেশীয় পোশাক গ্রহণ করেননি। আসলে দিয়েগোই এটি প্রস্তাব করেছিলেন, তাই তাঁর ডিভোর্সের পর পোশাকগুলো বাতিল করা এবং তাঁর চুল কেটে ফেলে দিয়ে তিনি দিয়েগোকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। চিত্রকর্মে মেক্সিকান ফ্রিদার হৃদয় অক্ষত, দিয়েগোর ছোট প্রতিকৃতি হাতে।

ইউরোপীয় ফ্রিদার হৃদয় তাঁর প্রিয় দিয়েগোর সঙ্গে সংযুক্ত নয় এবং তাঁর পোশাকের ওপর প্রচুর রক্তপাত হয়, পরনে ফ্রিদার ইউরোপীয় পোশাক।

ফ্রিদা কাহলোর প্রিয় হরিণ-শিশু গ্রানিজার সঙ্গে এই ছবিটা তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিক নিকোলাস মারের তোলা। ছবি: বিবিসি/নিকোলাস মারে ফটো আর্কাইভস

ফ্রিদার কাজের একটি পুনরাবৃত্তি থিম হলো রক্ত এবং এটি তাঁর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার প্রতিনিধিত্ব করে। আগের একটি চিত্রকর্মের মতো, তিনি ইউনিয়নের জন্য একটি রূপক হিসেবে রক্ত ব্যবহার করেন। কিন্তু ফ্রিদার জন্য, যিনি সন্তান ধারণ করতে অক্ষম ছিলেন, এটি নারীত্ব ও উর্বরতাকেও নির্দেশ করে। চিত্রকর্মটি সম্পর্কে যা পরিষ্কার, তা হলো যদিও ছবির দুজন ফ্রিদা যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েছে, তবু তারা একে অপরকে সমর্থন করছে। একটি সংযোগকারী শিরা ভালোবাসাপূর্ণ ও ভালোবাসাহীন ফ্রিদাকে একত্র করে—ইউরোপীয় ও মেক্সিকান ফ্রিদা। দুর্বল হৃদয়টি শক্তিশালীকে সমর্থন করে। এটি একটি সম্পর্কের ক্ষতি নিয়ে আঁকা চিত্রকর্ম। কিন্তু তাঁর পরিচয়ের দ্বৈততা চিত্রটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। একটি দ্বৈত জাতিগত পরিচয়ের জটিলতা এবং একজন ব্যক্তি কীভাবে উভয় দিকের ভারসাম্য বজায় রাখে, তা ফ্রিদার জন্য একটি আজীবন উদ্বেগ ছিল।

‘ফ্রিদা ও দিয়েগো’ নামক পেইন্টিংয়ে দিয়েগো হলেন বিশাল ব্যক্তিত্ব, তাঁর রঙের প্যালেট ও তুলি নিয়ে মহৎ শিল্পী, তাঁর ভক্ত বিনয়ী স্ত্রীকে সমর্থন করছেন, এমন। বিপরীতে তাঁদের বিয়ের শেষের দিকে আঁকা আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় ফ্রিদা আসলে নিজেই নিজেকে সমর্থন এবং সাহায্য করে যাচ্ছেন। তাঁর নিজের নারী, যিনি নিজেকে সমর্থন করছেন। ফ্রিদা ও দিয়েগো ১৯৪০ সালে পুনরায় বিয়ে করেছিলেন, তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের এক বছরেরও কম সময় পরে। তাঁদের সম্পর্ক বিশৃঙ্খল, অকার্যকর ও অস্থিরতাপূর্ণ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারেননি।