বাঘের রাজ্যে তিন দিন

নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে শামুকখোল পাখি
ছবি: রাজীব সরকার

কিছুদিন আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুন্দরবনে সাত বৎসর বইটি পড়েছি। তার পর থেকেই সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছিল। তবে ভাবতেও পারিনি যে এত দ্রুত আমার ইচ্ছাটা পূরণ হবে। গত ১৯ ডিসেম্বর খুলনার জেলখানা ঘাটে সকাল আটটায় যখন নৌকায় উঠলাম, তখনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছিল!

প্রথমে নৌকায় চেপে যাব নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজের কাছে। তবে নৌকাটা দেখেই আমি ঢোঁক গিললাম। এতজনের ভার সামলাতে পারবে তো? আমরা ছিলাম ১৭ জন। অবশ্য নৌকাটা ঠিকই সবাইকে নিয়ে নদীর বুকে ছুটে চলল। একসময় গিয়ে ভিড়লাম জলফড়িংয়ের কাছে। ও ভালো কথা, আমাদের জাহাজের নাম ‘জলফড়িং’। সবাই উঠে পড়লাম। মনে হলো, বিশাল এক তিমির পেটে ঢুকে পড়েছি!

রূপসা নদীর বুকে জলফড়িংয়ে চেপে শুরু হলো যাত্রা
ছবি: রাজীব সরকার

রূপসা নদীর বুকে জলফড়িংয়ে চেপে শুরু হলো যাত্রা। জাহাজেই দুপুরে খাওয়ার আয়োজন। খাওয়ার সময় বইছিল কনকনে ঠান্ডা বাতাস। সেই বাতাসে জাহাজের খাবার খেতে যে কী ভালো লাগছিল, বোঝাতে পারব না! এই প্রথম মধু খেতে খুব ভালো লাগল। খাওয়াদাওয়া শেষে জাহাজে বসে চারপাশটা দেখতে দেখতে বারবার ভাবছিলাম, ইশ্‌, কী সুন্দর! ইশ্‌, কী সুন্দর! নদীর দুপাশে কী সুন্দর গাছপালা, আকাশটা কী দারুণ, নদীটা বইছে কুলকুল করে!

মামার পায়ের ছাপ

সূর্যটা পাটে যাচ্ছে
ছবি: রাজীব সরকার

বিকেলে সুন্দরবনে পা রাখলাম! জায়গাটার নাম হাড়বাড়িয়া। সুন্দরী, গেওয়া, গোলপাতা, কেওড়াসহ নানান গাছে ভরপুর অপূর্ব সুন্দরবন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম সবাই—বাঘ! না না, বাঘমামার মুখোমুখি হইনি, মামার দেখা পাওয়া অত সহজ নয়। মামার পায়ের ছাপ দেখে সবাই থমকে দাঁড়ালাম। কাদামাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই বুক কাঁপাকাঁপি, সামনে পড়লে না জানি কী অবস্থা হয়!

পরদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে আমরা আবার বনে ঢোকার জন্য বের হয়ে পড়লাম। আমাদের জাহাজের পেছনে সব সময় একটা নৌকা বাঁধা ছিল। সেটা দিয়েই আমরা বনের কাছে গেলাম। আমাদের সঙ্গে একজন গাইড। তিনি বিভিন্ন গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, প্রাণী দেখাচ্ছিলেন। আমরা সুন্দরবনের ভেতর একটা ফাঁকা জায়গায় হাঁটছিলাম। জীবনে অনেক সূর্যাস্ত দেখেছি, কিন্তু কখনো সূর্যোদয় দেখিনি। সুন্দরবনে সেটাও দেখা হয়ে গেল। আমি তো বলব, সূর্যোদয় সূর্যাস্তের চেয়েও সুন্দর।

সমুদ্রে চাঁদ

ভদ্রলোকের মতো বসে আছে বানর
ছবি: রাজীব সরকার

সুন্দরবনে প্রথম যে প্রাণীটি দেখলাম, তা হলো বানর। আমাদের দেখেই বানরটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। এরপর অনেক দূর থেকে দেখলাম একটা হরিণকে। সকালবেলা বনের একটা ফাঁকা জায়গায় হাঁটাহাঁটি করার পর আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছলাম, যেখানে গাছপালা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে।

অনেক দূর থেকে দেখা সেই হরিণ
ছবি: রাজীব সরকার

জোয়ার-ভাটার কারণে গাছগুলোর এই অবস্থা। সে জায়গা থেকে গেলাম কটকা সি বিচে। কটকায় দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখে আমার অবস্থা হতবাক! কী সুন্দর সমুদ্রের ঢেউ। অনেক ছবি তুললাম।

জোয়ারে ভেসে আসা গাছ
ছবি: রাজীব সরকার

বিকেলে আমাদের হিরণ পয়েন্টে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাটার কারণে যেতে পারলাম না। বদলে গেলাম দুবলারচরে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ফিরে এলাম জাহাজে। জাহাজ থেকে বাইরে তাকাতেই বিস্ময় মুখটা হাঁ হয়ে গেল। আকাশে পূর্ণিমার গোলগাল চাঁদ। বঙ্গোপসাগরের পানিতে চাঁদের আলো কী ঝলমল করছিল! এমন সুন্দর দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখিনি।

পাখির চোখে

হরিণেরা চমকে তাকাল আমাদের দিকে
ছবি: রাজীব সরকার

পরদিন একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলাম। সেদিনই সুন্দরবনে আমাদের শেষ দিন। সকালের খাবার খেয়ে নৌকা নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমাদের এবারের গন্তব্য করমজল। সেখানে গিয়ে একটা কাঠের সেতু পার হয়ে ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম। টাওয়ার থেকে সুন্দরবন দেখে মনে হচ্ছিল, পাখি হয়ে গেছি!

বুনো শূকর খাবার খুঁজছে
ছবি: রাজীব সরকার

ওপর থেকে সুন্দরবনের সৌন্দর্য একেবারেই অন্য রকম। সেখানেও অনেক ছবি তুললাম আমরা। কাঠের সেতু দিয়ে ফেরার সময় দেখলাম, একটা বানর বসে আছে। ওই বানরের পেছনে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটার মতো দুঃসাহসিক কাজও করে ফেললাম শুধু ছবি তোলার জন্য। সুন্দরবনে বানরকে ভেংচি কাটতে বুকের পাটা লাগে।

সেরা ভ্রমণ

কত যে বিচিত্র গাছ সুন্দরবনে
ছবি: রাজীব সরকার

জাহাজে ফেরার পর খুব কষ্ট লাগছিল। এত তাড়াতাড়ি এই ভ্রমণ শেষ হয়ে গেল? দুপুরের খাবার খেলাম। দারুণ মজার খাবার। পোলাও, রোস্ট, চিংড়ি, সামুদ্রিক মাছসহ আরও কত কী! সুন্দরবনে যাওয়ার আগে মা আমাকে বলেছিলেন, ‘জাহাজে যে খাবার দেবে, সেটাই খাবে। খাবার নিয়ে কোনো ঝামেলা করবে না।’ কিন্তু আমি তো এখন বলব, জাহাজের খাবারগুলোই বাসার খাবারের থেকে ভালো!

সূর্যটা কী দারুণ
ছবি: রাজীব সরকার

খাবার খেয়ে সবাই নৌকায় উঠে বিদায় জানালাম জলফড়িংকে, সুন্দরবনকে। সবার মনই প্রচণ্ড বিষণ্ন। তবে এত কিছুর পরও আমার মনে একটা খুঁতখুঁত থেকেই গেল। সুন্দরবনে অনেক হরিণ, বানর, কুমির, বুনো শূকর দেখলাম; কিন্তু বাঘমামার দেখা তো মিলল না। তবু তিন দিনের এই ভ্রমণ এখন পর্যন্ত আমার সেরা ভ্রমণ।