ইঁদুলি বিবির কম্বল

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সারা দিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায় ইঁদুলি বিবি, সন্ধ্যা হলেই মাঠের খেজুরগাছটার মাথায় উঠে শুয়ে থাকে। কিন্তু আজ বেজায় শীত, মোটেও আরাম পাচ্ছে না। কাঁপতে কাঁপতে কাঁটা–পাতা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে দেখে, অন্য কোথাও যাওয়া যায় কি না! মাঠটা যেন ঘুমিয়ে আছে! ঝোপগুলো আর ওই দিকের বাঁশঝাড়ের ওপর অন্ধকার জমেছে।

লম্বা তালগাছগুলো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইঁদুলি বিবি ভাবে, শীতে তো আর থাকতে পারি না! যাই, ওই তালগাছের দিকে যাই। দেখি, একটু ওম পাই কি না!

ঝিঁঝিঁপোকা ক্যারক্যার করে ডাকছে। বাগান থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক। এই শীতে চাঁদ বাবাজিও পালিয়েছে। ইঁদুলি বিবির ভয় ভয় করতে থাকে। দ্রুতপায়ে ছুটতে থাকে। হঠাৎ বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে নরম কিছুতে পা পড়তেই বেশ আরাম লাগে। জিনিসটা কী, নাক–মুখ কুঁচকে গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করে ইঁদুলি বিবি। না, এ গন্ধ অপরিচিত। কুয়াশা ছড়িয়ে আকাশটা কেমন ঘুমাচ্ছে। ইঁদুলি বিবি ভাবে, এ জিনিস আকাশ থেকে পড়েছে। যা–ই হোক, বেশ ওম লাগছে; এর মধ্যে আজকের রাতটা পার করা যাক।

আসলে ওটা ছিল একটা কম্বল। শ্রীপুর বাজারে কম্বল বিতরণ হচ্ছিল, এক চোর এই পথ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় একটা পড়ে গেছে। চুরির জিনিস, অত সহজে কি ছাড়া যায়? কম্বলের খোঁজে ফিরে আসে চোর। টর্চলাইট নেই। পা ঘষে ঘষে ঠিকই সে কম্বল খুঁজে বের করে। ততক্ষণে কম্বলের একটা ভাঁজের মধ্যে আরামে ঘুমাচ্ছিল ইঁদুলি বিবি। হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে তার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর সে কী দোলা! হকচকিয়ে উঠে ইঁদুলি বিবি ভাবে, কী রে, পৃথিবী এত দুলছে কেন! ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?

আসলে হয়েছে কী, কম্বলটা ঘাড়ে তুলে জোর পায়ে বাড়ির পথ ধরেছে চোর। হাঁটার তালে তালে কম্বলের একটা ঝুল দুলছে, তার মধ্যে সেঁধিয়ে আছে ইঁদুলি বিবি, সেই দোলাই লাগছে গায়ে। ইঁদুলি বিবি তো একটা ইঁদুর, অতশত বোঝে না।

চোর ঘরে ফিরে খাটের ওপর কম্বলটা ফেলে দিয়ে বউকে বলে, ‘নাও, তোমার ভাইকে এটা দাও। কাল রাতে তো শীতে কাঠ হয়ে ছিল।’

বউ কম্বল পেয়ে বেজায় খুশি। জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় পেলে?’

চোর ভীষণ একটা ভাব নেয়। চোখ–মুখ পাকিয়ে বলে, ‘দেখতে পাচ্ছ না, নতুন? নতুন জিনিস কোথায় পাওয়া যায়? দোকানে, কিনেছি।’

বউ খুশি হয়ে পিঠা বানাতে যায়। চেয়েচিন্তে খেজুরের রস আনা হয়েছিল পাশের বাড়ি থেকে। ভাইটা পিঠা পিঠা করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল। কতই বা বয়স, ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে সবে।

তক্ষুনি ক্যা ক্যা করতে করতে তেড়ে আসে বউ। ওইটুকু ভাইয়ের গালে চড়! কেউ সহ্য করে? বাজে কম্বল, কাটা কম্বল ইত্যাদি বলে সে চেঁচামেচি শুরু করে। কম্বলের মধ্যে যে ধাড়ি ইঁদুর, নাম যার ইঁদুলি বিবি, বসে আছে—তা তো আর কেউ জানে না।

ভাই পিঠাটিঠা খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে মুঠোফোনে কার্টুন চালু করে। গত রাতে শীতের চোটে কার্টুন দেখা হয়নি। ইঁদুলি বিবির কিন্তু রকমসকম ভালো ঠেকে না। মুঠোফোনের আলোয় সে নিজেকে দেখতে পায়, মানুষের গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে। দেখেই ভয়ে কাইমাই করে হুড়োহুড়ি শুরু করে। আর ভাই বেচারা হঠাৎ কম্বলের মধ্যে ঠান্ডা খড়খড়ে কিছুর দাপাদাপিতে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। হাউমাউ করে সে কম্বল মারে ছুড়ে।

আর কাজটা করতে গিয়ে হাতের মুঠোফোনটা জোরে ছিটকে পড়ে। মেঝেতে বসে ভাত খাচ্ছিল চোর। ফোনটা আচ্ছা জোরে তার নাকে এসে পড়ে। চোরের মন, চুরি করে হালুকফালুক করছিল। তার ওপর নাকে আচমকা ঘা খেয়ে সে ভাবে কেউ বুঝি তাকে ধরতে এসেছে। ভয়ে নাক ঘষতে ঘষতে সে পালাতে গিয়ে দেখে, এ কাজ তার শ্যালকের। অমনি ভয়ের জায়গায় রাগ হয়। টেনে চাটি কষিয়ে দেয় শ্যালকের গালে! এমনিতে কম্বলের খড়খড়ানির ভয়, তার ওপর দুলাভাইয়ের চাটি, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে শ্যালক।

তক্ষুনি ক্যা ক্যা করতে করতে তেড়ে আসে বউ। ওইটুকু ভাইয়ের গালে চড়! কেউ সহ্য করে? বাজে কম্বল, কাটা কম্বল ইত্যাদি বলে সে চেঁচামেচি শুরু করে। কম্বলের মধ্যে যে ধাড়ি ইঁদুর, নাম যার ইঁদুলি বিবি, বসে আছে—তা তো আর কেউ জানে না। চেঁচামেচি ঝগড়াঝাটি তুমুল বেগে চলতে থাকে। তাতে যা হলো, এ বাড়িতে যে কম্বল এসেছে, সবাই জেনে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে দলবল নিয়ে চেয়ারম্যান এসে হাজির। বলেন, ‘কম্বল বিতরণ করছিলাম, চারটে পাচ্ছি না, কোথায়?’

তিনজনের মুখই ভয়ে চুপসে যায়। ভাইটি শুধু ভাবে, চেয়ারম্যানকে কতবেল দিয়ে শান্ত রাখবে। দুলাভাইয়ের বাড়িতে কী আর আনবে, চারটা বড় কতবেল এনেছিল। তার মাথায় কতবেলের চিন্তা। হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব তাকান তার দিকে। শীতে সে কাঁপছে। জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার নাম কী?’

এতসব কাণ্ডকারখানা, ভয়, তার ওপর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কতবেলের চিন্তা। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, কতবেল গাজী।

আসলে তার নাম কলিম গাজী। ‘কতবেল গাজী’ নাম শুনে চেয়ারম্যান হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়েন। এবার নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন, বেশ ভালো লোক। বলেন, ‘কম্বল থাকে থাক, একে একটা নতুন কম্বল দাও!’

হেঁকে–ডেকে লোকজন নিয়ে তিনি চলে যান। যাওয়ার আগে ভাইটিকে নতুন একটা কম্বল দিয়ে যান একজন।

আর ইঁদুলি বিবি? তার কী হলো? মানুষের এতসব কাণ্ডকারখানা দেখে সে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেছে। জানটা নিয়ে কোনোরকমে বাইরে বেরিয়ে এসে সে সাতবার করে নাকে খত দিল, না বাবা, যতই শীত করে করুক, ঠান্ডায় মরে যাই, তা–ও সই, তারপরও আমার নিজের বাড়িই খাসা। ওমের খোঁজে কোনো দিন আর পরের বাড়িতে ছুটবে না এ শর্মা।