গল্প কি জীবনের খণ্ডিত অংশ! অতলকে ছুঁতে চাওয়ার বহুমাত্রিক আলপনা! না যাপিত জীবনের চলিষ্ণু ছবি! সম্ভবত গল্পের কোনো সুনির্দিষ্ট, একক সংজ্ঞা নেই। তবে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার মাঝেই লুকিয়ে থাকে গল্পের সারবস্তু। সৃজনী মন আর অনুসন্ধিৎসু চোখ তা ঠিকঠাক তুলে আনে। নিষ্ঠা আর আন্তরিকতায় আসিফ নজরুল তাই করেছেন সংসার গল্পগ্রন্থে। লেখকের ১৭টি গল্পে ছড়িয়ে আছে আমাদের অদেখা ভুবন। কোনো বিমূর্ত ধারণা কিংবা বর্তমান সময়ের ফেসবুকীয় গদ্যভাষায় আটকে থেকে নয়, লেখক গল্প লিখেছেন ঋজু ভঙ্গিতে, মেদহীন সাধারণ ভাষায়। তিনি কখনো একটি বাক্যে, কিংবা একটি ঘটনার আবছায়া বর্ণনায় একটি জীবনযাপনের কথা বলতে চেয়েছেন। সেই যাপনের বয়ানটি মধ্যবিত্তের।
সংসার
আসিফ নজরুল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২১
দাম: ২৭০ টাকা।
পৃষ্ঠা: ১৩৪।
গ্রন্থটির প্রথম গল্পের শিরোনাম ‘সংসার’। গল্পের পাত্র-পাত্রী আবিদ ও ঝুমুর চিরচেনা শহুরে ক্লিশে জীবনকে মাড়িয়ে সজীব ভালোবাসাকেই অন্বেষণ করেছেন। কিন্তু দুজনেই, ‘ভালোবাসলে আসলেই কি হারিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখে মানুষ’ গল্পজুড়ে এ দার্শনিক ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়েছেন। লেখক নাগরিক বোলচালে নানামুখী নিরীক্ষায় পুষ্ট করেছেন তাঁর গল্পের উঠোন। হাসি-ঠাট্টার সহজিয়া মেজাজে প্রবেশ করেছেন অন্তে। অনায়াসে প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামোর গলদকে তীক্ষ্ণ শ্লেষে প্রকাশ করেছেন। এডিস সম্মেলন গল্পে আমরা দেখতে পাই, এডিস মশাদের সভা বসেছে রাজ্যের মশা নিবারণী সংস্থার ছাদে। মশা মারার নতুন ওষুধ এসেছে। কিন্তু সে নিয়ে মশাদের ভাবনা নেই। মশাদের ভয় খারাপ মানুষের রক্তে...চুষে খেলে রক্ষা নেই...নিশ্চিত মরণ। খারাপ মানুষেরা বড় বড় ঠান্ডা বাড়িতে থাকে, ঘুরে বেড়ায় বড় ঠান্ডা গাড়িতে। গল্পগ্রন্থটিতে সময়ের উলট পুরাণ থেকে শুরু, এই সময়ের সাংকেতিক ভাষা, মানবমনের হরেক কিসিমের জিজ্ঞাসা অনায়াসে নোঙর ফেলেছে। কাট-কপি-পেস্টের এই যুগে তাই জামিলদের লেখক হয়ে ওঠা, পুরস্কার আর ক্রেজি ফ্যান বাগানো চোখ এড়ায়নি। আশার আলোও অন্বেষণ করেছেন লেখক। তাই আনোয়ার করিমদের বিষণ্ন হাসি ও অস্বচ্ছ চোখের চাহনি থেকে জামিলদের মুক্তি নেই।
লেখকের মনোভূমিতে অনায়াসে আসা–যাওয়া করে কল্পিত ভুবন। বাস্তব কাহিনির নিটল বর্ণনায় ঢুকে পড়ে অলৌকিক জগৎ। সেই ভুবনের সুপার সেপিয়ানরা আত্মবিনাশী মানুষের স্বরূপ অন্বেষণ করলেও দিন শেষে সাদা রং টি শার্টে আস্থা রাখে। খুঁজে ফেরে প্রীতি-ভালোবাসা, যা সুপার সেপিয়ানদের জগতে নেই। মধ্যবিত্তের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য, হর্ষ-বিষাদ, মন খারাপ দুপুর, ঠাস বুনট, বিকেলের খবরাখবর স্বচ্ছ জলে দেখতে চেয়েছেন লেখক। কাদামাটির মতো গায়ের রং নিয়ে পাবনার শহীদেরা ধোয়া আতপ চালমুখী নেত্রকোনার রেশমাদের পেতে চায়। বিশেষ বিবেচনায় উত্তীর্ণের মতো একটা মর্যাদা নিয়ে সাইফুলরা সমাজের উঁচুতলায় মেশার সুযোগ পেয়ে জাতে ওঠে। চাকরিপ্রার্থীরা নতশিরে ইন্টারভিউ বোর্ডে সব অপমান সহ্য করে। কবির পঙ্ক্তি ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’ ঝুলে থাকে দেয়ালে-কল্পনায়। লেখকের প্রায় প্রতিটি গল্পে সমসময়ের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। গল্পকার মানুষের জীবন ও প্রাত্যহিক যাপনকে সর্পিল চোখে দেখতে চেয়েছেন। পোড়া, গন্তব্যহীন এ সময়ে আস্থা রেখেছেন, ভালোবাসায়, মনবিক বোধ আর সৌন্দর্যে।