প্রকৃত বাংলা ভাষাচর্চা
কোনো কোনো প্রবন্ধ পড়লেই মনে হয় এ তো নতুন কথা, এতদিন এভাবে কেউ তো বলেনি! মোহাম্মদ আজম সেই নতুন কথা বলার প্রাবন্ধিক-গবেষক। বিভিন্ন প্রবন্ধে তাঁর যুক্তিগুলো চমকে দেওয়ার মতো, পাঠককে চিন্তার জগতে অবগাহনের আহ্বান জানায় অবিরাম।
তাঁর নতুন বই বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার–এ তিনি কেবল বাংলা ভাষাচর্চার সমাচার জানিয়ে থামেননি; সেই বাংলা সমাচার সমঝে পাঠককে নতুন বন্দরের ঠিকানাও বাতলে দিয়েছেন। বইয়ের প্রবন্ধগুলো সম্বন্ধে দু–চার কথা বলতে বলতে আমরা এই আলোচনা এগিয়ে নেব।
বইয়ের সূচনাপত্রেই পাঠককে লেখক দেখিয়ে দেন আমাদের সমস্যা: ‘একটা আস্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের চোখের সামনে মাতৃভাষা আন্দোলন হয়ে উঠল।... সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য ইংরেজিকে আশ্রয় করে আর জাতীয়তাবাদী আবেগ রক্ষার দায়িত্ব বাংলার হাতে সোপর্দ করে আমরা ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি’।
বইটিতে রয়েছে বাংলা ভাষাচর্চাবিষয়ক আটটি গবেষণা-প্রবন্ধ। সূচনা প্রবন্ধের নাম ‘বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’। এখানে বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (২০১১) সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য: ‘বাংলা ভাষার “সংস্কৃত” ও “প্রাকৃত” অংশকে আলাদা কোটায় রেখে দেওয়ায় “মানবাংলার” স্বাধীন-সার্বভৌম ব্যাকরণের দাবি এ ব্যাকরণেও পূর্ণ হয়নি। তা ছাড়া “প্রমিত” বাংলার সংকীর্ণতাও রবীন্দ্রনাথ-প্রস্তাবিত “বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণে”র বিরোধী।’ ফলে তাঁর প্রস্তাব, ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষাবিষয়ক রচনার সমন্বিত পাঠেই এসব সংকট নিরসনের দিশা আছে।’
>বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার
মোহাম্মদ আজম
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২৩২ পৃষ্ঠা, দাম: ৪২০ টাকা।
‘বাংলা বানান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে দেখা যায়, ব্যুৎপত্তি নয়, ব্যবহার ও উচ্চারণই রবীন্দ্রনাথের বানান নির্ধারণের লক্ষ্য। আজম দেখান যে বাংলা বানান পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল থেকে গেছে ব্যুৎপত্তি অনুসারী আর উচ্চারণ অনুসারী—এ দুইয়ের মিশ্রণের কারণে। ‘তৎসম’ শব্দের জন্য এক বিধি আর অন্য শব্দের জন্য অন্য বিধি প্রণয়নের ফলে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা ও জটিলতাও।
অবার ‘প্রমিত বা মান বাংলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তিনি যা দেখিয়েছেন তাকে বলা যায় ‘মানভাষার রাজধানীতত্ত্ব’; এবং এই তত্ত্বের আলোকে বাংলা ভাষার দুই রাজধানীতে দুই রকম বাংলার কথা ইঙ্গিত করেছেন আজম। অথচ এ প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি আছে: ‘যে দক্ষিণী বাংলা লোকমুখে এবং সাহিত্যে চলে যাচ্ছে তাকেই আমরা বাংলা বলে গণ্য করব।’ এখানে স্পষ্ট রবীন্দ্রনাথ কেবল রাজধানীবাসীর মুখে চালু ভাষার কথাই বলেননি। এ ক্ষেত্রে বলা ভালো রবিঠাকুরের ‘শক্তিশালী সাহিত্যিকতত্ত্ব’কে স্মরণ না রাখলে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হবে এবং এ স্থলে তা–ই ঘটেছে বলেই মনে করি।
অন্যদিকে, ‘ঢাকার প্রমিত বা মান বাংলার সংকট’ প্রবন্ধে লেখক স্পষ্ট করে বলেন: ‘ঢাকার প্রমিত বাংলা কলকাতার প্রমিত বাংলা থেকে আলাদা।’ এখানেও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘রাজধানীতত্ত্ব’র দোহাই দেন এবং ‘সাহিত্যিকতত্ত্ব’ এড়িয়ে যান। অর্থাৎ শক্তিশালী সাহিত্যিকের আবির্ভাব ছাড়া যে ঢাকার ভাষার আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সে কথা বলেন না । যদিও প্রবন্ধের এক অংশে তিনি বলেন, ‘চালু শব্দ ভালো নয়’—এই কুসংস্কার ঢাকার শিক্ষিত সমাজের খারাপ গদ্য লেখার অন্যতম কারণ। আর তাঁর এই ‘খারাপ গদ্য’-ই যে ‘সাহিত্যিকতত্ত্ব’, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘একুশের চেতনা ও শিক্ষার মাধ্যম: বাংলা বনাম ইংরেজি’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। এ দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা পিছিয়ে পড়ার কারণ তিনি যথার্থই মনে করেন: রাষ্ট্র দেশীয় চাকরির বাজার-ব্যবস্থাপনায়ও গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা পেশ করতে পারেনি। বর্তমান বিশ্বের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখান যে বাংলাদেশের মতো ভাষা রপ্ত করার জন্য খোদ শিক্ষাটাকেই কোথাও বদলে ফেলা হয়নি। তবে এখানে আবার আশার বাণীও পাওয়া যায়: বাংলাভাষীদের নিজেদের বাজারই যথেষ্ট বড়। সুতরাং, পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ বাংলা ভাষার বাজারদর তথা মান বাড়াতে পারে।
এই বইয়ের পরিশিষ্ট ১-এ সন্নিবেশিত হয়েছে লেখকের নিজের একটি সাক্ষাৎকার। ‘ভাষা গণতান্ত্রিকতার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রধান অস্ত্র’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারে এটি স্পষ্ট হয় যে আজমের লক্ষ্য ঢাকার ভাষাকে মান বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কেননা তিনি মনে করেন, ‘প্রমিত’ স্থির করা হয়েছিল কলকাতায় এবং কলকাতার ভাষাকে কেন্দ্র করে। ওই বস্তু ঢাকায় স্রেফ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার নামের বইটি ভাষা প্রসঙ্গে বিভিন্নভাবে তর্কের জন্ম দেবে। বাংলা ভাষাচর্চাকারী মননশীল পাঠকের কাছে এ এক বাড়তি পাওয়া।