‘অপরাধ’ কারও কারও কাছে হয়তো মানানসই শব্দ। হিংস্রতা অপরাধের কাঁধে চড়েই হাঁটে। সুযোগ বুঝে হিংস্রতা অপরাধের কাঁধ থেকে নেমে সহিংস হয়ে ওঠে। আর এই সহিংসতাকেই কিছু মানুষ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। তারপর একসময় হিংস্রতা-সহিংসতাই হয়ে ওঠে তাদের জীবন যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ। লাতিন আমেরিকার উপন্যাস পাতালপুরীতে মচ্ছব-এ মোটা দাগে এ রকমই এক সহিংস জগতের আপাত সরল গল্প বলা হয়েছে। মেহিকান সাহিত্যিক হুয়ান পাবলো বিইয়ালোবোস লিখিত আলতোস-এর লাগোস দে মোরেনায় নামের মূল উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী।
হুয়ান পাবলো মেহিকান সাহিত্যিক হলেও মূল উপন্যাসটি তিনি লিখেছেন এস্পানিয়োল ভাষায়।
উপন্যাসটির ভারকেন্দ্র মাদক কারবারের সহিংস জগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। একই সঙ্গে মেহেকো দেশের অরাজক পরিস্থিতিকেও তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু উপন্যাসের আখ্যানভঙ্গিটি হাস্যকৌতুকে ভরপুর, শ্লেষাত্মক। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল উপন্যাসের হাস্যকৌতুক ও শ্লেষকে গল্পের বুননে ভাস্বর করে তোলা ছিল খুবই কঠিন কাজ। অনুবাদক চৌধুরী সেই পরীক্ষায় ভালোভাবেই উতরে গেছেন।
পাতালপুরীতে মচ্ছব
হুয়ান পাবলো বিইয়ালোবোস
অনুবাদ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ: আসিফুর রহমান
৭৯ পৃষ্ঠা, দাম: ২১০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত যেকোনো বইয়ের দোকানে।
উপন্যাসটির প্রথম বাক্য ঠিক এ রকম: ‘কেউ কেউ বলে আমি ইঁচড়ে পাকা।’ তো সেই ‘ইঁচড়ে পাকা’ বালক ততচলি বাবা জোলকাউতের চোখে প্রতিভাবান কিন্তু ‘খতারনাক পিচ্চি’। মূলত এই খতারনাক পিচ্চির বয়ানে বর্ণিত হয়েছে পুরো আখ্যান। ততচলির বাবা জোলকাউত ক্ষমতাধর এক মাদক কারবারের গ্যাংয়ের সর্দার। বর্বরতায়, হিংস্রতায় মেহিকানজুড়ে সে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। সে তার পুরো গ্যাং নিয়ে বাস করে এক প্রকাণ্ড প্রাসাদে। ততচলির প্রাসাদে রয়েছে ১০টি ঘর। এই ১০ ঘরের কোনো কোনোটা অস্ত্রশস্ত্রে, কোনোটা আবার হীরা-মাণিক্য, ডলার, ইউরো আর মেহিকোর মুদ্রা পেসোতে ঠাসা। প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সব ঐশ্বর্যই রয়েছে, কিন্তু চলনবলনের অপার স্বাধীনতা সেখানে নেই। তাই জোলকাউতের আবাস সুরম্য প্রাসাদ হলেও এ এক পাতালপুরী।
সেই পাতালপুরীতে প্রায় প্রতিদিন নানা রকম মচ্ছব লেগেই থাকে। উপরন্তু ততচলির নানা রকম উদ্ভট বায়নায় জোলকাউতকে তটস্থ থাকতে হয় সব সময়। প্রাসাদের ছাদবারান্দায় বাঘ, সিংহ, নানা জাতের বিড়াল, পাখি থাকলেও সে বায়না ধরল আফ্রিকার লাইবেরিয়া দেশের এক বাচ্চা জলহস্তী তার চাই-ই চাই। অতঃপর বায়না মেটাতে তাদের লাইবেরিয়ার জঙ্গল ভ্রমণ, একটির জায়গায় দুটি জলহস্তী সংগ্রহ, মাফিয়াদের ভয়ংকর অভিসন্ধি ততচলির বর্ণনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সেই ‘খাতারনাক পিচ্চির’ বিস্ময়কর উপলব্ধিও পাঠককে ধন্দে ফেলবে।
বালক ততচলির কথায়, ‘রাজা হওয়ার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না। শুধু মাথায় একটা মুকুট পরলেই হলো; ব্যস, তোমার রাজ্যের লোকজন তোমাকে অর্থকড়ি দেবে লাখ লাখ।’
গ্যাংয়ের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জোলকাউত ততচলিকে বলেছিল, ‘গ্যাং মানে তো মিথ্যা বলা নয়, গ্যাং মানে তো সংহতি, সুরক্ষা এবং সত্য গোপন না করা।’ কিন্তু প্রতিভাবান ততচলি একসময় তার পিতার প্রকৃত পরিচয় আবিষ্কার করে। ততচলির ভাষায়, ‘জোলকাউতের কাছে সত্য আর মিথ্যায় কিছু যায় আসে না।’
গোটা উপন্যাসে ততচলির টুপিপ্রীতি পাঠকদের দৃষ্টি কাড়বে। তার বয়ানে ‘আকাশে উড়বার সময় কবুতররা তাদের কাজটা সারে। টুপি পরা না থাকলে মাথাটা ময়লা হয়ে যায়।’ কিন্তু ততচলির এই সরল কথনে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না। এই টুপিপ্রেমের সঙ্গে রাজার মুকুটের একটা সাযুজ্য রয়েছে। কেমন সাযুজ্য? পুরোটা জানতে তরুণ মেহিকান কথাসাহিত্যিক হুয়ান পাবলো বিইয়ালোবোসের পাতালপুরীতে মচ্ছব উপন্যাসে ডুব দেওয়াই ভালো হবে।