>১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য রকম এক যুদ্ধ করেছিলেন শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। সেই যুদ্ধের বর্ণনা আছে তাঁর নিন্দিত নন্দন বইয়ে। বিজয়ের এই মাসে তাঁর গল্প এবং তাঁর লেখা সেই বই সম্পর্কে লিখেছেন শীলা আহমেদ।
চার-পাঁচ বছর আগের কথা। এক ঈদের পরদিন আমার স্বামী বলল, আমাকে সারপ্রাইজ দেবে। এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাব। আমাকে ধানমন্ডির একটা বাসায় নিয়ে গেল। পুরোনো দিনের বাসা। বাসার গেট বন্ধ। কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। আমরা কোনো কলবেল খুঁজে পেলাম না। গেটে দুজন মিলে কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলাম। কেউ এল না।
আমি বললাম, আমি খুবই সারপ্রাইজড! এখন বলো, আমরা কার বাসার দরজা ধাক্কাচ্ছি?
ও খুবই মন খারাপ করে বলল, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বাসা। ভুল হয়েছে। ওনাকে ফোন করে আসা উচিত ছিল।
তুমি আগে এসেছ?
হ্যাঁ, এসেছিলাম। এত সুন্দর বাসা। তখনই ঠিক করেছিলাম, তোমাকে নিয়ে আসব। আর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও বারবার বলেছেন তোমাকে নিয়ে যেতে। উনি তোমাকে খুব স্নেহ করেন।
উনি তো আমাকে চেনেনই না। সারা জীবনে কোনো দিনও আমাদের দেখা হয়নি। আমাকে স্নেহ করবেন কেন। উনি ভদ্রতা করে তোমাকে বলেছেন, আমাকে স্নেহ করেন। তুমি শীলাকে বিয়ে না করে মিলা-বিলা-তিলা—যাকেই বিয়ে করতে, তাকেই উনি নিয়ে যেতে বলতেন।
কেন চিনবেন না? আসলেই তোমাকে স্নেহ করেন। আমাকে বলেছেন।
তাহলে হয়তো বিখ্যাত মানুষের মেয়ে অথবা বিখ্যাত মানুষের বউ হিসেবে স্নেহ করেন। এ রকম স্নেহ আমি নিই না। শুধু ‘আমি’ হিসেবে যাঁরা আমাকে স্নেহ করেন, তাঁদেরটা আমি নিই।
তোমার বাবাকে ভালোবাসেন বলে যদি কেউ তোমাকেও ভালোবাসেন, তাহলে সমস্যা কী?
আমার সমস্যা আছে।
দুই.
সে ঘটনার পর আমার সঙ্গে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর দুবার দেখা হয়েছে। একবার আমরা ওনার একটা প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। উনি বসেছিলেন দরজার কাছে। সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন আসার জন্য। আরেকবার পত্রিকায় পড়লাম, উনি অসুস্থ, হাসপাতালে আছেন। তখন আমরা দেখতে গেলাম।
ওনার ছেলে বললেন, নাশতা খেতে পারছেন না। ডায়াবেটিস খুব বেড়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে পাউরুটি খেতে দেয়। ডায়াবেটিস কন্ট্রোল না হলে অপারেশনও করা যাচ্ছে না।
আমি বললাম, আমাদের বাসা তো কাছেই। আমি নাশতা পাঠাতে পারব।
উনি খুবই আস্তে আস্তে বললেন, রুটি-ভাজি পাঠিয়ো।
সমস্যা হলো আমি রুটি বানাতে পারি না। আমাদের বাসায় দুটি মেয়ে থাকে—আকলিমা আর সাবিনা। ওরাই বাসা দেখে রাখে, বাচ্চাদের দেখে রাখে। সারা দিন অনেক কাজ করতে হয়। তাই সকালে রুটি-ভাজি বানাতে বললে ওরা একটু বিরক্ত হয়। সন্ধ্যায় ওদের ডেকে আমি বললাম, একজন অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে আছেন। ওনাকে সকালে নাশতা পাঠাতে হবে। আমি সবজি রান্না করব। আর যে রুটি বানাতে রাজি হবে, সে বকশিশ পাবে।
আকলিমা বলল, মানুষটা কে?
একজন অনেক বড় মুক্তিযোদ্ধা।
আমি রুটি বানাব। বকশিশ লাগবে না। আমার বাবাও তো মুক্তিযোদ্ধা।
সাবিনা জানাল, ওর বাবা মুক্তিযোদ্ধা না, কিন্তু সে–ও বকশিশ ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধার জন্য রুটি বানাতে চায়।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা শুধু দুদিন ওনাকে রুটি পাঠাতে পারলাম।
তিন.
কিছুদিন আগে আমার বড় বোন নোভা আমার কাছে জানতে চাইল, আমি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর লেখা নিন্দিত নন্দনটা পড়েছি কি না। আমি পড়িনি। নোভা বইটা পড়তে বলল। বলল, খুব ভালো বই।
আমি বইটা পড়লাম। প্রথমেই মনে হলো, এত দিন বইটা আমি পড়িনি কেন? শেষের দিকে একটু তাড়াহুড়া করে লেখা, কিন্তু সেটা উল্লেখ করার মতো না। এটা কোনো সহানুভূতি পাওয়ার জন্য লেখা বই না। ‘দেখো আমি বীরাঙ্গনা, আমি কত দুঃখী’—সে কোনো রকম বই না। ‘মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ’—সে রকম বইও না। এই বইটা শুধুই ওনার জীবনের বই। অনেকের মনে হতে পারে, উনি এই করলেন না কেন, সেই করলেন না কেন। কিন্তু আমার পড়ে মনে হয়েছে, কারও জীবনের গল্প শুনতে হলে আমরা তো বিচারকের ভূমিকা নিতে পারি না। ওনার জীবনে যা ঘটেছে, সেটাই শুনতে হবে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা প্রকৃত যুদ্ধের বই, যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার বই।
বইতে উনি যেভাবে নিজের জীবনের কথা লিখেছেন, আমি তা পড়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। এত অকপটে লেখা যায় জীবনের সবকিছু! নিজেকে জাহির করার চেষ্টা নেই। ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা নেই। স্বামীকে মহান বানানোর চেষ্টা নেই। অপছন্দের মানুষকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে আদিখ্যেতা নেই। এত স্পষ্ট, এত সত্যি!
আমার স্বামীকে বললাম, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এখন আমার খুব প্রিয় মানুষের একজন। ওনার মেয়ের ফোন নম্বর জোগাড় করে দাও। আমি ওনার মেয়েকে ফোন করব।
কী বলবে ওনার মেয়েকে?
জানি না কী বলব, কিন্তু খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
চার.
আমার মা–ও ৯-১০ বছর আগে তাঁর জীবনের কথা লিখতে শুরু করেছিল। সারা দিন গুটগুট করে ডায়েরি লিখত। একদিন আমাকে পড়তে দিল। আমি ২-৩ পাতা পড়ার পর ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম সেই ডায়েরি। বলেছিলাম, তুমি এসব লিখতে পারবে না। অসম্ভব। মানুষের সামনে বাবাকে ছোট করতে পারবে না।
যা সত্যি, তা লিখতে পারব না?
না, পারবে না। যদি লেখো, জীবনেও আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমি এখনই বাসা থেকে বের হয়ে যাব।
আমি তো শুধু লিখেছি। ছাপাইনি। এমন করছ কেন?
হ্যাঁ, আমার মা ছাপায়নি। ছাপাতে পারেনি। আমি বাধা দিয়েছি। আমি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ছেলেমেয়েদের মতো বড় মনের মানুষ না। তারা তাদের মাকে উৎসাহ দিয়েছে নিজের সংগ্রামের কথা লিখতে। আর আমি আমার মাকে যতভাবে পারা যায় বাধা দিয়েছি। আমি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ছেলেমেয়েদের ধন্যবাদ জানাতে চাই তাদের মাকে বইটা লিখতে দেওয়ার জন্য। ছেলেমেয়েরা বাধা দিলে সত্যিকারের আত্মজীবনী লেখা খুব কঠিন।
আর আমার মাকে আমি বলতে চাই, মা, তোমাকে লিখতে বাধা দেওয়ার জন্য সরি। অন্যরা না জানুক, আমরা তো জানি, তোমারটাও যুদ্ধেরই গল্প। আর তোমার গল্পের শেষটাও বিজয় দিয়েই।