বিশ্বরাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যে উপন্যাস
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী তাবাসসুমের ব্যক্তিজীবনের সংকটকে ঘিরে আবর্তিত লুনা রুশদীর ‘আর জনমে’ উপন্যাসে বর্তমান বিশ্বরাজনীতির নানা দিক উঠে এসেছে, যা পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় জিজ্ঞাসার সামনে। উন্মোচিত করে এই রাজনীতির অমানবিক, অসাড় প্রান্তগুলো।
উপন্যাসের বর্ণনা একরৈখিক নয়। সমান্তরাল। একই সময়ে বয়ে চলেছে তাবাসসুমের দুই জীবন! ব্যক্তিগত সংকটকে কেন্দ্র করে বিপরীত দিকে ছুটে চলা এই দুই জীবনের বিভেদতলে, তার মনে শুধু আত্মগত দুঃখ জমাট বেঁধে থাকেনি বরং সেই দুঃখবোধ যেন অনেকটাই ম্লান হয়ে উঠেছে চারপাশের মানুষকে নিয়ে মানবিক ভাবনায়।
তাই তাবাসসুমকে বলতে শুনি, ‘যে দুনিয়ায় প্রাণভয়ে নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আসা শিশুর লাশ ভেসে ওঠে সাগরের তীরে, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ বেঁচে থাকে রিফিউজি ক্যাম্পে, যেখানে শুধু ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে আগুনে পোড়ায়, গুলি করে মারে, বোমা মেরে উড়ায়ে দেয়…সেই একই দুনিয়ায় যদি ধাড়ি একটা মাঝবয়সী চল্লিশ পার হওয়া মহিলা টেবিলে মিষ্টিকুমড়া বাড়া হওয়ার দুঃখে কাঁদতে থাকে, তার চেয়ে বিরক্তিকর আর কী হতে পারে? নিজেই নিজেকে শাসন করি, কাম ডাউন তাবাসসুম।’ ব্যক্তিগত দুঃখবোধকে সরিয়ে মানুষের বেদনার সঙ্গে একাত্ম হওয়া অর্থাৎ বিশেষ থেকে নির্বিশেষে যাত্রা এই উপন্যাসকে একধরনের বিশিষ্টতা দিয়েছে।
আর জনমে
লুনা রুশদী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ১১২ পৃষ্ঠা;
দাম: ৩২০ টাকা।
বইগুলো পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে
বর্তমানের যাপিত জীবনের এক সন্ধ্যায় স্মৃতিতে ভর করে তাবাসসুম ফিরে যায় উনিশ বছর আগে, তুহিনের সঙ্গে চার বছরের সংসারজীবনে। স্মৃতি ছাড়া মানুষের কী–ই বা অবশিষ্ট থাকে! তার মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই সে ছুঁতে পারবে তুহিনের সঙ্গে যাপন করা সেই সব মুহূর্ত! তুহিনের পরিচিত শরীর, বুকের ওঠানামা, উষ্ণ নিশ্বাস সবকিছু। কিন্তু পরপর তিনবার গর্ভপাত তার জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। ভেতরে ভর করে মাতৃত্বের হাহাকার, একধরনের অক্ষমতার বোধ। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার একপর্যায়ে সে সরে আসে তুহিনের জীবন থেকে।
উপন্যাস শুরু হয়েছে এক অভিবাসী নারী নিকিতার প্রবাসজীবনের সংকটের খণ্ডাংশ চিত্রায়নের মাধ্যমে। উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয়প্রার্থী ইরানি-কুর্দি সাংবাদিক বেহরুজ বুচানির মানুস দ্বীপে বন্দী জীবনের কথা। এই বন্দী জীবনে বসে তিনি লিখেছেন তাঁর দুর্বিষহ জীবনকাহিনি ‘নো ফ্রেন্ড বাট দ্য মাউন্টেইনস’। বইটি অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ারস পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও লেখক অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের অনুমতি পাননি। উপন্যাসের এই অংশ ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির সময় কারাবন্দী আন্তোনিও গ্রামসির লেখা ‘প্রিজন নোটবুকস’ বইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয় চট করে।
লুনা রুশদী শাসকশ্রেণির অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি খোলাসা করতে পাঠককে টেনে নিয়ে যান আরও ১০ বছর পেছনে ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসে। বিপন্ন প্রজাতির গোল্ডেন বেল ব্যাঙের জীবনযাপনে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য কর্তৃপক্ষ অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছিল তাদের পরিকল্পনা। অস্ট্রেলিয়ায় সেটলারদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত ‘বুশ ব্যালাড’; যে গানে বিস্তারিত হয়েছে ভ্রাম্যমাণ এক শ্রমিকের জীবনযাপন, অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মর্যাদার দিক দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতের পাশে তাকে জায়গা দেওয়া হয়। এ সবকিছুর বিপরীতে পাঠকমনে আশ্রয়হীন অভিবাসীদের দুর্দশার চিত্র ভেসে ওঠে প্রবলভাবে।
গর্ভপাতের হতাশা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার দৃশ্য দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তাবাসসুম। এ ঘটনার পর সারা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ার যে ঝড় ওঠে, সেই ঝড়ের দমকা বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায় তার পরবর্তী জীবন। মুসলিম পরিচয় জেনে তাকে দেখাশোনা না করার সিদ্ধান্ত নেয় হাসপাতালের নার্স। একধরনের হীনম্মন্যতা আর সংকোচ জেঁকে বসে তার ভেতরে।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’ বইয়ে ভবিষ্যৎ বিশ্বরাজনীতির রূপরেখা টানতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সংঘাত শুরু হবে যার যার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সত্তা টিকিয়ে রাখাকে কেন্দ্র করে।’ তাবাসসুম বর্তমানের যে পৃথিবীতে বাস করে, সেখানে শাসকেরা ধর্মকে ব্যবহার করছেন নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে। রোহিঙ্গা সংকট, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি, ভারতের রাজনীতি এবং একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যার দিকে তাকালে তা সহজেই চোখে পড়ে। লুনা রুশদী রাজনীতির এসব প্রবণতার ইঙ্গিত দিয়েছেন এই উপন্যাসে।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে হামলার পর তাবাসসুম ভাবতে থাকে, তাকে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আবার হয়তো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কিন্তু জানা যায়, সন্ত্রাসী হামলাটি করেছে একজন অমুসলিম।
উপন্যাস শেষ হয়েছে একটি আশাবাদ আর সহমর্মিতার মিছিলের মধ্য দিয়ে; ‘রক্তকরবী’ নাটকের শেষ দৃশ্যের মতো। যেখানে জাতি-ধর্ম, সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভুলে সবাই একত্র হয়েছে এই নৃশংস সন্ত্রাসী হামলাবিরোধী শান্তির মিছিলে।