এক দশক আগে, বাংলা অন্তর্জালের বিভিন্ন–বিচিত্র স্বাদের লেখাজোখার পাঠক যখন সীমিত হয়ে আছে কেবল প্রযুক্তি-শিক্ষিতদের মধ্যেই, হারুন রশীদ নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে তখনই। তারপর তাঁর টুকটাক লেখা নিয়মিত বেরোতে শুরু করল পত্রপত্রিকায়। খেয়াল করলাম, ইতিহাস নিয়ে তাঁর কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে ক্রমে তাঁকে পরিচিত করে তুলছে। থাংলিয়ানা পড়া শেষে বলতেই পারি, হারুন রশীদের ইতিহাসবিদ পরিচয়টা এখন রীতিমতো পোক্ত।
থাংলিয়ানা ইতিহাস ঘরানার বই, আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ঐতিহাসিক এক ব্যক্তিত্বের স্মৃতিকথার অনুবাদ এটি। বইয়ের পুরো নাম থাংলিয়ানা, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান ১৮৬৫-১৮৭২। মূল বইটির রচয়িতা ব্রিটিশ প্রশাসক থমাস হারবার্ট লুইন, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যিনি কর্মরত ছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বেশ কিছুটা সময়। সেই লুইনের স্মৃতিকথা আ ফ্লাই অন দ্য হুইল–এর নির্বাচিত কিছু অংশের অনুবাদ এই থাংলিয়ানা। মূল বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।
১৮৬৫ সালে চট্টগ্রাম শহরে পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে আসেন তরুণ ব্রিটিশ অফিসার হারবার্ট লুইন। কিন্তু চট্টগ্রামে দায়িত্বরত অবস্থায়ও লুইনকে আকৃষ্ট করছিল শহরের পূর্ব দিগন্তের ওই পার্বত্য অঞ্চল। লুইনের বাঙালি সহকর্মীরাও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেন না তখন; তাঁদের কাছে ওই আদিবাসী–অধ্যুষিত রহস্যময় অঞ্চলটি এমন ছিল, যেখানে পা রাখলে আর ফিরে আসা যায় না।
সত্যি বলতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই অঞ্চলে ইতিপূর্বে পা পড়েনি কোনো ইউরোপীয়র। এক ফ্রান্সিস বুখানন ১৭৯৮ সালে চট্টগ্রামের দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত যাত্রা করেছিলেন, তারপর কর্ণফুলী নদী ধরে গিয়েছিলেন বরকল এলাকা পর্যন্ত। তবে তাঁর সেই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক, কোম্পানির জন্য মসলা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। কিন্তু হারবার্ট লুইনের পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিযান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, রোমাঞ্চপ্রিয় এক কিশোরের মতোই তিনি বারবার হারাতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের পাহাড়ে। ১৮৬৫ সালের নভেম্বরে প্রথমবার পাহাড়ে গিয়ে তিনি মুখোমুখি হন মুরংদের; এরপর বছরের পর বছর ধরে কখনো তিনি অভিযান চালিয়েছেন যুদ্ধবাজ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সেন্দুদের গ্রামে, কখনো ‘জাদুর ক্ষমতা’ দেখিয়ে সমীহ আদায় করেছেন দুর্ধর্ষ লুসাইদের কাছ থেকে।
হারুন রশীদের স্বচ্ছন্দ অনুবাদে লুইনের স্মৃতিকথাটি পড়তে গেলে কেবল মনে পড়ে স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড রচিত অমর চরিত্র অ্যালান কোয়ার্টারমেইনকে। কালো মানুষের আফ্রিকায় একেকটি অভিযানে নেমে অ্যালান কোয়ার্টারমেইন আমাদের যেমন শোনাতেন অরণ্যের আদিবাসীদের উদ্ভট সব প্রথা কি সংস্কৃতি, হারবার্ট লুইনও তেমন সাদা চামড়ার প্রশাসকের চেয়ার থেকে বহিরাগত মানুষের দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা জাতির বিচিত্র সব প্রথার বর্ণনা করেন। এটাও স্বীকার করতে হয়, অ্যালানের আফ্রিকা-প্রেমের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের সরল মানুষদের প্রতি লুইনের প্রেমও অকৃত্রিম। ঔপনিবেশিক শাসক হলেও বছরের পর বছর নিজের কাজের মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন মানুষটি। সাদা মানুষ অ্যালানকে আফ্রিকার আদিবাসীরা যেমন সম্বোধন করত ‘মাকুমাজান’ নামে, থমাস লুইনও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কাছে তেমনি হয়ে উঠেছিলেন ‘থাংলিয়ানা’—এমনকি চিরশত্রু লুসাইদের কাছেও!
অ্যালান কোয়ার্টারমেইনের ছকে ফেলা অভিযানের মতোই থাংলিয়ানা লুইনের স্মৃতিকথাও শেষ হয়েছে এক বিশাল যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে। ১৮৭২ সালে লুসাইদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সেই যুদ্ধের রণনীতি অনেকটাই নির্ধারণ করেছিলেন তত দিনে ওই এলাকা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা লুইন। মজার ব্যাপার, সেই যুদ্ধের মূল কারণও—অ্যালানের অভিজ্ঞতাগুলোর মতোই—একজন নারী! ১৮৭১ সালে এক চা-বাগানের ম্যানেজারকে হত্যা করে তাঁর ছয় বছর বয়সী শিশুকন্যা মেরি উইনচেস্টারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লুসাই বিদ্রোহীরা। তখন চা-বাগানের মালিকেরা এক হয়ে ব্রিটিশ সরকারের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করে, তার ফলেই ১৮৭২ সালে লুসাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ব্রিটিশরা। শেষ পর্যন্ত সরকারি বাহিনী মেয়েটিকে উদ্ধারে সমর্থ হয়। আর লুসাইরাও এক অর্থে চলে আসে ইংরেজ শাসনের অধীনে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী রাজা বা রানিশাসিত অঞ্চলগুলোতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে লুইনের স্মৃতিকথা তাই এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর সব বাদ দিলেও লেখক যে পর্যবেক্ষণগুলো করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ে, শুধু নৃতাত্ত্বিক কারণেই সেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
সুহান রিজওয়ান
থাংলিয়ানা, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান ১৮৬৫-১৮৭২
থমাস হারবার্ট লুইন
অনুবাদ: হারুন রশীদ
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা; ২০০ পৃষ্ঠা;
দাম: ৫০০ টাকা।
বই পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে