শিক্ষার রূপান্তর: অতীতের আলোকে ভবিষ্যতের পথরেখা
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মনজুর আহমদের একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর বইটি এ বছর বাংলা একাডেমির ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ পেয়েছে
শিক্ষা বিষয়ে এ দেশে যাঁদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে শুনতে হবে, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির একজন মনজুর আহমদ। তিনি দেশে–বিদেশে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় শিক্ষা বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবন শিক্ষার সব স্তর সম্পর্কে পড়াশোনা, গবেষণা ও কাজের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। শিক্ষকতা ও শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নের অভিজ্ঞতাও তাঁর শিক্ষাভাবনাকে পুষ্ট করেছে। দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন, ইউনিসেফ ও ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টে শিক্ষা ও শিশুর বিকাশ নিয়ে গবেষণা ও কাজ করেছেন। বলা যায়, মনজুর আহমদ আদ্যন্ত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অন্দরের খাস বাসিন্দা। ফলে শিক্ষা নিয়ে তাঁর লেখা বইয়ের গুরুত্বই অন্য রকম।
একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর
মনজুর আহমদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ৩৬৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৮৫০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।
একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর নামে মনজুর আহমদের শেষ বই প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। বইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লিখেছেন দেশের আরেক শিক্ষাবিদ ও কৃতী শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ভূমিকার লেখক মনজুরের দৃষ্টিতে ‘বিদ্যমান (শিক্ষা) ব্যবস্থা অকার্যকর এবং তাই এর সংস্কার অথবা পুনর্নির্মাণ তখন অবধারিত হয়ে পড়ে’। কয়েক লাইন পরে তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষা এখন একটা অচলাবস্থার সম্মুখীন, এর রূপান্তর না হলে ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের কাতারে জায়গা পাওয়া তো দূরের কথা, উন্নয়নশীল বিশ্বেও বর্তমান অবস্থানটা ধরে রাখা যাবে না’ (পৃ. ১২)। এ কথাও ভূমিকার লেখক মনজুর লিখেছেন যে শিক্ষার বর্তমান অবস্থার রূপান্তরের কাজে বর্তমান বইটি নানাভাবে সাহায্য করবে।
মনজুর আহমদ তাঁর বইটিকে চারটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্বে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে যেসব কাজ হয়েছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। আলোচনায় পরিসংখ্যানভিত্তিক প্রাসঙ্গিক চিত্রও দেওয়া হয়েছে, যা পরিবর্তনের অন্তত সংখ্যাতাত্ত্বিক ধারণা দেয়। এ পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়টির গুরুত্ব হলো, এতে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ও শিক্ষায় জাতিগত উন্নতির জন্যে তাঁর আন্তরিক আগ্রহ স্পষ্টভাবে জানা যায়।
দ্বিতীয় পর্বে মনজুর আহমদ দেশে প্রচলিত শিক্ষার সব স্তর ও সব ধরন সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। এ সূত্রে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া যত ধরনের বেসরকারি উদ্যোগ হয়েছে ও রয়েছে, সেগুলোও আলোচনায় এনে বিষয়টিকে তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। তাঁর জানা–বোঝার পরিধি ব্যাপক ও গভীর। ফলে সব আলোচনায়ই প্রাসঙ্গিক লক্ষ্য ও আদর্শ, নীতি-বিধান, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। এর ফলে গবেষক ও সাধারণ পাঠকের জন্য পুরো বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হয়েছে। তদুপরি সংক্ষেপে প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ই ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল লেখকের। সেই সুবাদে ইতালীয় শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্তেসরি যে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ১৯৪০ সালে ভারত সফরে আসেন, সে তথ্য কবির আমন্ত্রণলিপিসহ পাঠক জানতে পারেন। এই অধ্যায়ে যেমন প্রাক্-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষার আলোচনা আছে, তেমনি আছে উপখাত হিসেবে বিবেচিত উপানুষ্ঠানিক ও জীবনব্যাপী শিক্ষার কথাও। বিস্তারিত আলোচনায় প্রতিটি স্তর ও খাতের মূল্যায়ন করেছেন লেখক।
তৃতীয় পর্বে এসে মনজুর আহমদ স্তর ও উপখাতনির্বিশেষে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। শিক্ষায় দুটি বিষয়ের গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেছেন—ব্যক্তির সম্ভাবনা পূরণ ও দেশের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির সক্ষমতা। কোনো আলোচনায়ই লেখক নিজের কোনো ধারণা চাপিয়ে দেন না, তিনি প্রাসঙ্গিক সব বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি সর্বাধুনিক বৈশ্বিক ধারণা এবং তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থাও তুলে ধরেন। এই পর্বের প্রথম অধ্যায়ের (বইয়ের ৯ম অধ্যায়) শিরোনাম ‘আদর্শ শিখনের সন্ধানে’। সবাই জানি যে এই ক্ষেত্রে ব্যাপক অবক্ষয় হয়েছে। শিক্ষকের যোগ্যতা, সদিচ্ছা, নৈতিকতার সব ক্ষেত্রেই শোচনীয় অবস্থা। তবে মনজুর আহমদ ব্যক্তিগত অনুভূতি ও মনোভাবকে কিছুতেই প্রাধান্য নিতে দেননি, বরং গবেষকের নিরাবেগ মনীষার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি ধাপে ধাপে আলোচনাকে কার্যকর একটি লক্ষ্যের দিকে নিয়ে গেছেন। আদর্শ শিক্ষকের আলোচনায় তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘শিক্ষার্থীর অর্জনে শিক্ষকের ভূমিকা আছে, এমন আপ্ত বাক্য উচ্চারণই যথেষ্ট নয়’ (পৃ. ১৯২)।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা পর্যালোচনার পর তিনি আমাদের জানান, সবার জন্য শিক্ষার মান নিশ্চিতে চারটি কৌশলের সুপারিশ করা হয়েছে ইএফএ গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্টে। সেগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে সংক্ষেপে তা তুলে ধরছি। প্রথমত, সর্বোত্তম ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিক বৈচিত্র্য শিক্ষক নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে; দ্বিতীয়ত, শিক্ষক প্রশিক্ষণের লক্ষ্য হবে দুর্বলতম শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া; তৃতীয়ত, দক্ষতর শিক্ষককে সুযোগবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্যে নিয়োজিত করতে হবে এবং সব শেষে শিক্ষকতার পেশায় দক্ষতা ধরে রাখার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে (পৃ. ১৯২-৯৩)। এই পর্বেই আলোচিত হয়েছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার বিষয়টি। এ নিয়ে সাধারণের যেমন আগ্রহ বেশি, তেমনি নিজস্ব ধারণা ও আবেগভিত্তিক নানা অগ্রাধিকারের ভাবনাও জোরালো। অথচ ক্ষেত্রটি যে কোনো একক বিষয়কেন্দ্রিক নয়, বরং বহু বিষয়ের এক যৌথ ক্ষেত্র তা বোঝানো জরুরি। লেখক একটি সারণির মাধ্যমে নৈতিকতা-মূল্যবোধের ক্ষেত্র ও এতে সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত বিষয় এবং পাঠ্যবইয়ে তার উল্লেখের পরিমাণও তুলে ধরেছেন। তাতে দেখা যায় যে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিশ্বাসই ক্ষেত্রটির অর্ধেকটাজুড়ে স্থান পায়। তবে এতে আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক, সমাজ ও জাতির সদস্যদের দায়িত্ব, বিশ্বনাগরিক ও মানবসমাজের অংশ হিসেবে দায়িত্ব, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন, পরিবেশ ও ধরিত্রী রক্ষা, নারী-পুরুষ সম্পর্কে ন্যায্যতা-সমতা, শিশুর প্রতি আচরণ এবং নৈতিকতা রক্ষায় ও পালনে তৎপরতার জন্য সময় বরাদ্দ রয়েছে (পৃ. ২৪৩)।
বইয়ের চতুর্থ পর্বের প্রথম অধ্যায়ে (বইয়ের অধ্যায় ১৩) প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার আর্থরাজনীতি আলোচিত হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে সমাজ রূপান্তরের অর্থাৎ ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিবর্তনের রূপকল্পের ভিত্তিতে রচিত ২০টি অগ্রাধিকারসংক্রান্ত বিধান উল্লেখিত হয়েছে। কোথায় কীভাবে শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন এসেছে এবং এ কাজে আন্তর্জাতিক কী কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা মনজুর আহমদের অধিগত রয়েছে। ফলে প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় আকর্ষণীয় ও কার্যকর করে লার জন্যে তাঁর পক্ষে মোক্ষম দৃষ্টান্ত তুলে আনা সম্ভব হয়েছে। এই সূত্রেই দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জনপ্রিয়তা ও বারবার সরকার গঠনের সাফল্যের পেছনে যে শিক্ষার রূপান্তর কাজ করেছে, সে তথ্যও তিনি তুলে এনেছেন (পৃ. ৩০৫-৬)। অথচ বাংলাদেশ এখনো শিক্ষায় চাহিদা অনুযায়ী ব্যয় করছে না, আন্তর্জাতিক ও দক্ষিণ এশিয়ার মানদণ্ডে এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। তবে আশার কথা যে ক্ষমতাসীন দলের সাম্প্রতিক নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। এ সময় এসডিজির লক্ষ্য পূরণের তাগিদও থাকছে। সরকারের একুশ শতকে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য বিবেচনায় রেখে মনজুর আহমদ ঠিকই বলেছেন, এর জন্যে প্রয়োজন শিক্ষার রূপান্তর। সে কাজ শুরু হয়েছে, এটাই আশার কথা।
মনজুর আহমদের বইটি আদতে একটি আকর গ্রন্থ, এর কার্যকারিতা আরও বহুকাল ধরেই বহাল কবে। নানা তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত ঘেঁটে লেখক বাংলাদেশের শিক্ষার বাস্তবতা এবং তার কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের পথরেখা এ বইতে তুলে ধরেছেন। এবারে মনজুর আহমদের কাছ থেকে তাঁর নিজের শিক্ষাচিন্তার একটি ভাষ্য আমরা চাই।