রোকেয়া বিষয়ে সামান্য পড়াশোনা এবং অল্প–আধটু লেখালেখির অভিজ্ঞতায় যে বিষয় আমাকে গোড়া থেকেই ভাবিয়েছে, রীতিমতো অবাক করেছে, তা হলো, একই সময়ে ও সমাজে বাস করে আর সে সমাজের জাগরণ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েও, রোকেয়া ও নজরুল—বাঙালি মুসলমান সমাজের এই দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোথাও কোনো উপলক্ষে যোগাযোগ ঘটল না কেন?
নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকায় রোকেয়ার কয়েকটি রচনা ছাপা হয়েছিল। তখন কলকাতা বা বাংলায় মুসলিম নারী লেখকের সংখ্যাও আঙুলে গোনা যেত। রোকেয়ার সাহিত্যসাধনার কথা বাদ দিলেও, কলকাতা শহরেই তাঁর বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা, মহিলা সমিতি (আঞ্জুমানে খাওয়াতিন) ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ সম্পর্কেও নজরুল অবহিত ছিলেন না, এ একরকম অসম্ভব। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ প্রমুখ অনেকেই ছিলেন যাঁরা রোকেয়া ও নজরুল উভয়ের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন এবং যোগাযোগ রাখতেন। রোকেয়ার অন্তত দুজন ভাবশিষ্যা বেগম শামসুন নাহার (মাহমুদ) ও সুফিয়া এন হোসেন (পরবর্তীকালে সুফিয়া কামাল) তো নজরুলের স্নেহাশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেগম শামসুন নাহার রোকেয়া ও নজরুল দুজনকে নিয়েই বই লিখেছেন।
নজরুল যে শুধু ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে কবিতা বা গান লিখেছেন, তা তো নয়; মাতৃসম্বোধনে বিরজাসুন্দরী দেবী বা মিসেস এম রহমানের মতো কাউকে কাউকে কবিতা উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু বয়সে তাঁর চেয়ে উনিশ বছরের বড় সময়ের এই দুঃসাহসী ও জ্যোতির্ময়ী নারী ও সর্বার্থে মহীয়সী ব্যক্তিত্ব রোকেয়া, কী এক অজ্ঞাত কারণে জানি না, নজরুলের কাছে শেষাবধি উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন। রোকেয়ার জীবনকালে কিংবা তাঁর মৃত্যুর পর কোথাও নজরুল তাঁর সম্পর্কে একটি বাক্যও লেখেননি বা বলেননি। এমনকি রোকেয়ার মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে ১৯৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে যে নাগরিক শোকসভা হয়, তাতে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের অনেক বিশিষ্টজন উপস্থিত থাকলেও এবং প্রয়াত এই লেখক ও শিক্ষাব্রতীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও নজরুল তাতে উপস্থিত হননি। যদিও নজরুল তখনো সুস্থ ও সক্রিয় (তিনি অসুস্থ হন আরও ৯ বছর পর, ১৯৪১ সালের শেষ দিকে)। রোকেয়ার মৃত্যুর পর মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা তাঁর স্মরণে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয়, মাঘ ১৩৩৯/১৯৩২ সংখ্যা হিসেবে যা প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদীর আগের সংখ্যায় এই বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ বিষয়ে যে বিজ্ঞাপন বা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তাতে ‘মরহুমা মিসেস আর এস হোসেন–সম্পর্কিত’ অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে নজরুলের লেখা কবিতাও থাকবে বলে জানানো হয়েছিল। কবি বা লেখকদের নামের তালিকায় স্বাভাবিকভাবেই সর্বাগ্রে নজরুলের নাম উল্লেখিত হয়েছিল। কিন্তু উক্ত বিশেষ সংখ্যায় শেষ পর্যন্ত নজরুলের কোনো লেখা ছাপা হয়নি (খুব সম্ভব যোগাযোগ করেও লেখা পাওয়া যায়নি)। বিশেষ ক্রোড়পত্র শুরু হয় কবি শাহাদাৎ হোসেনের একটি দীর্ঘ কবিতা ‘দরদী আম্মা’ দিয়ে। কবি গোলাম মোস্তফারও একটি দীর্ঘ কবিতা (দুঃসাহসিকা) ছিল এই ক্রোড়পত্রে। রোকেয়ার ব্যাপারে নজরুলের এই নীরবতা বা উদাসীনতার কারণ হয়তো কোনো দিনই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে না। অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর সম্পাদিত রোকেয়া প্রয়াণলেখ: সাময়িকপত্রে সাক্ষ্য ও অন্যান্য গ্রন্থের ভূমিকায়ও এ বিষয়ে, বিস্ময় ও পরিতাপ প্রকাশের অতিরিক্ত, রহস্যভেদের কোনো আভাস বা ইঙ্গিত আমাদের দিতে পারেননি।
প্রসঙ্গত রোকেয়ার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের অগ্রসর নারীদের (যেমন স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী চৌধুরানী, ইন্দিরা দেবী) অনবহিতি বা উদাসীনতারও উল্লেখ করে এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত বইয়ের ভূমিকায়। আর তা যৌক্তিকও বটে। রোকেয়ার জীবদ্দশায়ই তাঁর প্রধান রচনাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর কিছু রচনা এ সময় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পাঠকদের কমবেশি দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁদের মধ্যে কিছুটা হলেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। রোকেয়ার সবচেয়ে আলোড়ন বা বিতর্ক সৃষ্টিকারী রচনাটি তো প্রথমে ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র মাসিক মহিলা পত্রিকায়ই প্রকাশিত হয় (যদিও তখন লেখাটিতে রোকেয়ার নাম ছিল না)। এরপরও হিন্দু ও মুসলমান সম্পাদিত নানা পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। এমনকি রবীন্দ্র প্রভাববলয়ের পত্রিকা প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ ও সবুজপত্রতেও রোকেয়ার রচনা বা তাঁর অভিভাষণ প্রকাশিত হয়। রোকেয়ার মৃত্যুর পরও রবীন্দ্রনাথ প্রায় ৯ বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও তিনি রোকেয়ার সাহিত্যিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি। অন্তত তাঁর কোনো লেখায়, ভাষণে বা বিবৃতিতে তার প্রমাণ নেই।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষ কত লেখকই তো রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের বই পাঠাতেন, মতামত ও আশীর্বাদ চেয়ে চিঠি লিখতেন। যথারীতি সেসব চিঠির উত্তরও দিতেন রবীন্দ্রনাথ। এভাবেই আবুল ফজল ও সুফিয়া কামালের বই পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন। রোকেয়া হয়তো তাঁর দিক থেকে উদ্যোগী হয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সে রকম যোগাযোগ করেননি, তাঁকে কখনো নিজের লেখা বই পাঠাননি কিংবা তাঁকে চিঠি লেখেননি। কিন্তু অন্য কেউও রোকেয়ার মতো সমকালের এমন একজন অনন্য চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব, প্রতিভাময়ী লেখকের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। ঠাকুরবাড়ির নারীরা বাংলার নারী জাগরণ, বিশেষ করে তাঁদের অবরোধমুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রণী বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁরাও কলকাতা শহরেই মুসলমান সমাজের মধ্যে কাজ করা এই ‘নারী জাগরণের অগ্রদূতি’র কর্মপ্রয়াস, তাঁর চিন্তা ও মনন-ঐশ্বর্যের কোনো খোঁজ রাখেননি। যেখানে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ এমনকি বার্মা মুলুক থেকেও কেউ কেউ রোকেয়ার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। সরোজিনী নাইডুর মতো সর্বভারতীয় নেত্রী হায়দরাবাদ থেকে নিজেই রোকেয়াকে চিঠি লিখে তাঁর ‘সাহসী কর্মকাণ্ড’, ‘আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা’র ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং একজন নারী হিসেবে নিজেকেও এর জন্য গর্বিত ভেবেছেন।
অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির পত্রিকা মাসিক মোহাম্মদী রোকেয়ার মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, অথচ সওগাত তেমন কিছু করেছে বলে জানতাম না। যদিও সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে রোকেয়ার ছিল চেতনাগত মিল বা নৈকট্য। এ নিয়েও আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। তবে আমার আলোচনা বা গবেষণার বিষয় যেহেতু রোকেয়ার জীবন নয়, মূলত তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি, অন্য কথায় রচনাকর্মের ওপরই নিবদ্ধ ছিল, আমি বিষয়টি নিয়ে অধিক অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইনি। রোকেয়া প্রয়াণলেখ-এ আবুল আহসান চৌধুরীর ভূমিকা পড়ে প্রথমবারের মতো জানতে পারলাম, রোকেয়া যখন মারা যান, তখন সওগাত-এর প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।
অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী সংকলিত ও সম্পাদিত রোকেয়া: প্রয়াণলেখ: সাময়িকপত্রের সাক্ষ্য ও অন্যান্য অ্যালবামসদৃশ বইটিতে রোকেয়ার মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার ক্রোড়পত্রের প্রতিচিত্র, মাসিক মোয়াজ্জিন পত্রিকার রোকেয়া-সংখ্যার লেখাসমূহ, বাংলা ও ইংরেজি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর মৃত্যুসংবাদ, শোকবাণী ও স্মৃতিতর্পণমূলক রচনা, শোকসভার বিজ্ঞপ্তি, সংবাদ বা বিবরণ, গৃহীত প্রস্তাব ও ভাষণ, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যে রোকেয়ার অন্তিমকালের বর্ণনা, রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষায় কলকাতায় ও বাংলাদেশে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও তার বাস্তবায়নসংক্রান্ত তথ্য ও সচিত্র বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। সেদিক থেকে বইটিকে একটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ বলা যায়। সাধারণ পাঠকের কৌতূহল মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতের রোকেয়াগবেষকদের বিশেষ কাজে আসবে বলে মনে করি।
এ রকম একটি গ্রন্থের পরিকল্পনা ও তার সুচারু বাস্তবায়নের জন্য বিশিষ্ট গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীকে অভিনন্দন জানাই। ধন্যবাদ পাঠক সমাবেশকে এ রকম সুমুদ্রিত ও সুন্দর একটি প্রকাশনার জন্য।