সাম্প্রতিক
যে কারণে বড়দেরও পড়তে হবে ছোটদের বই
দুনিয়াজুড়ে বেড়েছে সহিংসতা। শিশু-কিশোরেরা হয় সহিংস, নয়তো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হচ্ছে। এর কারণ কী? বর্তমান পৃথিবীতে বড়দেরও কেন পড়তে হবে শিশুদের বই? বিবিসিসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজেছেন সুজন সুপান্থ
ঠাকুরমার ঝুলি শেষ কবে পড়েছেন? সেই ছোটবেলায়? কিন্তু কবে? প্রশ্নটির সঠিক উত্তর হয়তো মিলবে না। কারণ, সেই নির্দিষ্ট দিনক্ষণ আপনি ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ বয়সে এসে ছোটবেলার বই পড়া নিয়ে কথা কেন? উত্তর জানার আগে আরেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিই। নিজের ছোট্ট সন্তান বা বাড়ির ছোটদের হাতে কি এখন ওই বইগুলো তুলে দেন আপনি? আগের মতো ছোটদের ঠাকুরমার ঝুলি বা রূপকথার গল্পগুলো পাঠ করে শোনান? গত দেড় দশকে শিশু ও মুঠোফোন নিয়ে করা গবেষণাগুলোর দিকে তাকালে এর উত্তর মিলবে। মুখে কথা ফোটে কি ফোটেনি ঘরে থাকা এমন বয়সের ছোট্ট শিশুটিও এখন স্মার্টফোনে ভিডিও দেখায় ব্যস্ত। আর বড়রা ব্যস্ত নিজের কাজে।
আগে ছোটরা খেলাধুলা, পাখির বাসা খোঁজা, গুলতি বানানো—নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আর এখন তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হচ্ছে। সহিংসও হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমেই। আবার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে অল্প বয়সী বড় বোন গুলি করে ছোট বোনকে হত্যা করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বড়দের মধ্যেও বেড়েছে হতাশা ও রেষারেষি; বৃদ্ধি পেয়েছে হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ ও সহিংসতাও। তাহলে কি মানুষ বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে?
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর সারা বিশ্বের প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রায় ১০ লাখ বই প্রকাশিত হয়। আর ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব বই প্রকাশিত হয়, সেই সংখ্যা মিলিয়ে বছরব্যাপী প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। গুগল বুকস পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪৪০ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্রের জন্য ধাতব টাইপ উদ্ভাবনের পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ কোটি ৯৮ লাখ ৬৪ হাজার ৮৮০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। যদিও গুগল বুকসের পরিসংখ্যানে ব্যক্তি উদ্যোগে বের হওয়া বই এবং ই-বুকের হিসাব নেই। অন্য পক্ষে আমাদের বাংলা একাডেমির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এবারের বইমেলায় মোট ৩ হাজার ৭৩০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। গত ১ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই।
বই তো মানুষকে আলোকিত করে। তাহলে এত এত বই প্রকাশ ও বই কেনার পরও মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে কেন? এ থেকে উত্তরণের উপায়ই-বা কী? প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন ব্রিটিশ লেখক ও শিক্ষাবিদ ক্যাথেরিন রান্ডল। তাঁর মতে, ছোটদের তো শিশুতোষ বই পড়তেই হবে। বড়দেরও এখন পড়তে হবে শিশুদের বই। তাঁর ভাষ্যে, ‘শিশুসাহিত্য আমাদের এমন বিষয় পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে, যা আমরা হয়তো জানিও না যে সেসব আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বড়দেরও প্রেরণা হতে পারে এসব বই।’
‘প্রাপ্তবয়স্ক জীবন ভুলে ভরা; আমি যাঁদের সঙ্গে দেখা করেছি, তাঁদের বেশির ভাগকেই ভুলে গেছি; যে বইগুলো পড়েছি, তার অধিকাংশই ভুলে গেছি। এসব বিষয়কেই পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে শিশুদের কথাসাহিত্য।’
‘বড়দের কেন ছোটদের বই পড়া উচিত’ শিরোনামের নিবন্ধে ক্যাথেরিন রান্ডল এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধে ক্যাথেরিন রান্ডল আরও বলেন, ‘যখন আমি লিখি, তখন দুজনের জন্য লিখি। এই দুজন হলো ১২ বছর বয়সী আমি ও বর্তমান আমি। আমি চাই, শিশুরা জানুক আর বড়রা মনে রাখুক।’
বড়রা মনে রাখবে তাই শিশুতোষ বইয়ের কাছে ফিরতে হবে তাঁদের—এমন অভিমত ক্যাথেরিন রান্ডলের।
তো রান্ডলের কথা থেকে এবার বাঙাল মুলুকে ফেরা যাক। সুকুমার রায়ের জীবনী পড়লে দেখা যাবে, তাঁর ডাকনাম ছিল তাতা। ছোটবেলায় ‘রাগ বানাই’ বলে নিজের তৈরি করা একটা খেলা ছিল তাতার। হয়তো তিনি কারও ওপর রেগে আছেন, কিন্তু শোধ নেওয়ার উপায় নেই। তখন তিনি ‘আয়, রাগ বানাই’ বলে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে অদ্ভুত সব গল্প বানিয়ে বলতে থাকতেন। এর মধ্যে কোনো বিদ্বেষ বা হিংস্রভাব থাকত না। ওই ব্যক্তির ক্ষতি হবে, এমন কোনো কথাও থাকত না, ছিল শুধু মজার কথা। এ খেলার ভেতর দিয়েই তাঁর রাগ পানি হয়ে যেত। এমন আদর্শ নিয়েই ছোটদের জন্য লিখতেন সুকুমার রায়। রান্ডলের কথা মানলে এ শিক্ষা এখন যেমন শিশুদের দিতে হবে, একই আচরণ করতে হবে বড়দেরও।
শিশুতোষ নানা ধরনের লেখার পাশাপাশি শিশুদের জন্য আরেক রকমের লেখা আছে—রূপকথার গল্প। ক্যাথেরিন রান্ডল বলেন, ‘রূপকথার গল্প কেবল শিশুদের জন্য নয়, এসব শিশু, বৃদ্ধ ও যুবক, নারী–পুরুষ সবার জন্য। প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমাদের সেসব পড়তে হবে, শিকড়ের কাছে ফিরতে হবে।’
রান্ডলের সুরে সুর মিলিয়ে রূপকথার গল্প–বিশেষজ্ঞ মেরিনা ওয়ার্নারও যুক্তি দিয়েছেন, ‘রূপকথাগুলো আমাদের সংস্কৃতির কাছের বিষয়। জার্মান, পারস্য, আমেরিকান—যা-ই হোক না কেন, আমরা একই রূপকথা বলি। কারণ, এসব গল্প পাখির মতো অবাধে সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে।’ তাঁর ভাষায়, সব রূপকথার মূল উপাদান একই। এসব গল্পে সাধারণত একটি পরি, একটি মন্ত্র ও একটি জাদুর গাছ থাকবে, যা মূলত আশা দেখাবে। এসব গল্পে সহিংসতা, অন্যায় ও দুর্বৃত্তায়নের উদ্রেকও থাকে। কিন্তু শেষে এটা বলে, এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। রূপকথার গল্পগুলো ভয়কে জাগিয়ে তোলে এটা বলার জন্য যে আমাদের এত ভয় পাওয়ার দরকার নেই। হতাশার কারণ নেই। সামনেই আছে সফলতা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন কাগজ আরও সাশ্রয়ী হয়, তখন শিশুসাহিত্য শিশুদের প্রকৃত ইচ্ছাকে বিবেচনায় নিতে শুরু করে। শুরু হয় শিশুদের জন্য উপন্যাস লেখা। এ সময় শিশুদের বইয়ের প্রথম স্বর্ণযুগ শুরু হয়। শিশুদের কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে ক্যাথেরিন রান্ডল বলেছেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক জীবন ভুলে ভরা; আমি যাঁদের সঙ্গে দেখা করেছি, তাঁদের বেশির ভাগকেই ভুলে গেছি; যেসব বই পড়েছি, তার অধিকাংশই ভুলে গেছি। ভুলে গেছি, কীভাবে সংশয়বাদ ও ফ্যাশনকে একপাশে রেখে একটি বইয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হয়। এসব বিষয়কেই পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে শিশুদের কথাসাহিত্য। এই কথাসাহিত্য আপনাকে আবার শেখাতে পারে, কীভাবে খোলা হৃদয়ে পড়তে হয়।’
আদতে শিশুদের বই-ই মূলত আমাকে-আপনাকে শেখাতে পারে—আমরা যা ভুলে গেছি তা নয়, বরং আমরা ভুলে গেছি যে আমরা কী কী ভুলে গেছি, সেসব। এসব বইয়ের মধ্য দিয়ে হয়তো আমরা ফিরে পেতে পারি ছোটবেলা, যেখানে রয়েছে আমাদের অনুপ্রেরণার সূত্র।
এ রকম নানা কথা বলার পর শেষে ক্যাথেরিন রান্ডল বলেছেন, ‘শিশুদের উপন্যাস এখনো আমাকে আশার কথা বলে। জাদুকর, সিংহ ও কথা বলা মাকড়সার মাধ্যমে উদারতা দেখায়, সাহসী হওয়ার পথ দেখায়। শিশুদের বই শেখায়—এই পৃথিবী বিশাল। বিশাল পৃথিবীতে আশাবাদী হতে হবে। এখানে সাহসিকতা গুরুত্বপূর্ণ, বুদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, সহানুভূতি গুরুত্বপূর্ণ, প্রেম গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, এসব কথা শোনা ও এসব নিয়ে এ সময় কথা বলা ভীষণ জরুরি।’