মধুসূদনের ‘রিজিয়া’ কেন গুরুত্বপূর্ণ

মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদ্বিশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে প্রথমা প্রকাশন লেখকের ইংরেজিতে লেখা রিজিয়া: এমপ্রেস অব ইনডি নামের একটি অসমাপ্ত কাব্যনাট্য প্রকাশ করেছে। একটি দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য, গবেষণাধর্মী ও সুলিখিত ভূমিকা রচনাসহ বইটির সম্পাদনা করেছেন লেখক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান। ১৯৬৫ সালে প্রথমে প্রকাশিত মধুসূদন রচনাবলিতে রচনাটি স্থান পেলেও প্রথমা প্রকাশনই প্রথম এটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করল। মধুসূদন মাদ্রাজে অবস্থানকালে (১৮৪৮–৫৬) এটি রচনা করেন এবং তাঁর নিজের সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইউরেশিয়ান-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। ১০ নভেম্বর ১৮৪৯ থেকে সাত সপ্তাহব্যাপী মুদ্রণের পর এটির রচনা ও প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এই বন্ধের কারণ জানা যায় না। কাব্যনাটকটির নবম দৃশ্য পর্যন্ত তিনি লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতায় তিনি এটি সমাপ্ত করার কিংবা ‘রিজিয়া’ নামে আরেকটি নতুন নাটক রচনার উদ্যোগ নিয়ে কোনোটিতেই সফল হতে পারেননি।

এই কাব্যনাট্যের বিষয় ঐতিহাসিক চরিত্র ভারতের প্রথম নারী সম্রাট সুলতানা রাজিয়া (১২০৫-৪০)। ১২৩৬ সালে পিতা সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তাঁর মনোনয়ন অনুযায়ী রাজিয়ার ক্ষমতাসীন হওয়ার কথা থাকলেও পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। সম্রাটের পদে আসীন হন বৈমাত্রেয় ভ্রাতা রুকুনুদ্দিন ফিরোজ। কিন্তু বিলাসিতা, পানাসক্তি ও শাসনকার্যে অদক্ষতা তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসন ও জনমনে যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে, তার সুযোগ নিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁকে হটিয়ে সুলতানা রাজিয়া ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতাকাল মোটেই নির্বিঘ্ন হয়নি। প্রাসাদ ও আমলাতান্ত্রিক নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও অসন্তোষের কারণ হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে হত্যার শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি।

সুলতানা রাজিয়া যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, প্রবল ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। বিদ্রোহ দমনে সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। দরবারে প্রথম দিকে পর্দার আড়াল থেকে শাসন পরিচালনা করলেও বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী পরিচালনা করতে গিয়ে পুরুষবেশী সেনাপতি রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। মাথায় টুপি ও গায়ে চাদর জড়িয়ে তিনি প্রজাদের মুখোমুখিও হতেন। সবচেয়ে বেশি যে বিরূপতাকে তাঁর মোকাবিলা করতে হয়, তার নাম পুরুষতন্ত্র। দিল্লি কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রাদেশিক নানা কেন্দ্র থেকে ক্ষমতালোভী শাসনকার্য–সংশ্লিষ্ট পুরুষেরা এই নারী সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জোট বাঁধে। তিনি পুরুষতন্ত্রের কাছে হার মানতে চাননি, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে আগ্রহী হননি। তবে শেষ দিকে এক শক্তিমান ষড়যন্ত্রকারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, এটা ঠিক। কিন্তু তাতে তাঁর শেষরক্ষা হয় না। হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম পরিণতিই ভারতবর্ষের প্রথম নারী সম্রাটকে বরণ করতে হয়। কিন্তু তাতে তাঁর তেজস্বিতা, দার্ঢ্য ও গৌরব বরং বৃদ্ধিই পায়।

ভারতের প্রথম নারী সম্রাটের এই গৌরবান্বিত রূপই মধুসূদনকে আকৃষ্ট করেছিল। এরপর ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে ভারতসম্রাজ্ঞীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া (১৮১৯-১৯০১) উনিশ শতকের শেষার্ধে। ব্যবধান ছয় শ বছরের বেশি। মাঝখানে পুরো ভারতবর্ষের নয়, বিজাপুর ও আহমদনগরের শাসক হন চাঁদ সুলতানা (১৫৫০-৯৯), রাজিয়ার সাড়ে ৩০০ বছর পর। সুতরাং প্রথম নারী সম্রাট হিসেবে রাজিয়ার গৌরবময় জীবনসংগ্রাম মধুসূদনের শিল্পভাবনা ও সাহিত্যপ্রকল্পে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হওয়ার মতো গুরুত্ব লাভ করেছিল। মধুসূদনের সাহিত্যদর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও কিছু বিষয় ‘রিজিয়া’ কাব্যনাট্য রচনার অনুপ্রেরণা-উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এর স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কারও অসম্ভব হবে না।

মধুসূদনের গ্রন্থতালিকাটির দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে সেখানে নারীজীবনের প্রাধান্য অবশ্যই লক্ষ করব। প্রথম বইটির নামই ক্যাপটিভ লেডি (১৮৪৯)। অসমাপ্ত কাব্যনাট্য হলেও দ্বিতীয় গ্রন্থ-পরিকল্পনা ‘রিজিয়া’কে নিয়ে। বাংলায় লেখা প্রথম নাটক শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯)। তারপর পদ্মাবতী নাটক (১৮৬০), তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬০), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১), কৃষ্ণকুমারী নাটক (১৮৬১) ও বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২)। ক্যাপটিভ লেডি কাব্যের প্রধান অংশজুড়ে আছে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী দেবীগণ, দৈত্যরাজকন্যা শর্মিষ্ঠা; গ্রিক পুরাণের কাহিনি নিয়ে পদ্মাবতী, তিলোত্তমা ও দানবনিধনের দেবতা-ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা, ব্রজাঙ্গনা তো রাধা, আর বীরাঙ্গনা পৌরাণিক ১১ নারীর প্রেমমহিমা। ব্যতিক্রম শুধু কৃষ্ণকুমারী আর রিজিয়া পার্থক্য দুটি। কৃষ্ণকুমারী ১৮-১৯ শতকের রাজপুতকন্যা দুই বিরুদ্ধ রাজশক্তির লোভের শিকার। আর রিজিয়া ১৩ শতকের বীরত্বমণ্ডিত নারী সম্রাট। আরও ব্যতিক্রম ধর্মীয় পরিচয়ের ভিন্নতা। মধুসূদন কলকাতায় আসার পর রিজিয়া কাহিনি নিয়ে নাটক লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু ক্ষেত্র গুপ্ত জানাচ্ছেন, বেলগাছিয়া থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ মুসলমানি বিষয়ের প্রতি অনীহা প্রকাশ করলে তিনি রাজপুত ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে কৃষ্ণকুমারী লেখেন।

তাঁর পরিকল্পনা থেকেই বোঝা যায়, সমকালীন উপনিবেশশাসিত কলকাতার সাম্প্রদায়িক মনোভাব দ্বারা মধুসূদন প্রভাবিত ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, তাঁর রেনেসাঁস-পরিস্রুত মনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল নারীর বীরত্বব্যঞ্জকতা, সংগ্রামশীল ব্যক্তিত্ব, সম–অধিকারবোধ, প্রণয়াগ্রহ ও সর্বোপরি সামগ্রিক মুক্তিচেতনা। উনিশ শতকের ইউরোপীয় সমাজতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিকেরা নারীর অধিকারবোধ ও ব্যক্তিত্ববোধ নিয়ে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, মধুসূদনকে তা নিশ্চিতভাবে আকৃষ্ট করেছিল। নারীবাদী তত্ত্ব তখনো অতটা গভীর আলোচনা-বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে ওঠেনি। তবু নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মধুসূদনকে পাঠ করলে আমরা নতুনভাবে তাঁকে আবিষ্কার করতে পারব বলে আশা করি। সেদিক থেকে রিজিয়া কাব্যনাট্যটিও (অসমাপ্ত হলেও) একটি নতুন মাত্রা অর্জন করতে পারবে।

সৈয়দ আজিজুল হক

রিজিয়া: এমপ্রেস অব ইনডি

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ভূমিকা ও সম্পাদনা

মোরশেদ শফিউল হাসান

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২৪; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ৭২ পৃষ্ঠা; দাম: ২২০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং বইমেলায় বইটি পাবেন প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে (প্যাভিলিয়ন: ৬)।