‘একজন লেখক যখন প্রেমে পড়েন, তখনই তিনি তাঁর সেরা লেখাগুলো লেখেন।’ কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন বিশ্বসাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম মার্কিন লেখক আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে। আর এ জন্যই বোধ হয় তিনি বারবার প্রেমে পড়েছেন। আমেরিকান কথাসাহিত্যের অঙ্গনে বিপ্লবী ভূমিকা রাখা এক লেখক, এক দক্ষ গুপ্তচরের পরিচয়ের বাইরেও হেমিংওয়ে তীব্রভাবেই ছিলেন প্রেমিক! লেখকদের জীবনে নারীদের আনাগোনা তো সাহিত্য অঙ্গনে নতুন কোনো বিষয় নয়, তবু কেন আলাদাভাবে এই বইয়ের অবতারণা?
এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে বইটি পড়ার পর। দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময় শক্তিশালী ও চিরাচরিত প্রথার বাইরে গিয়ে লেখার জন্য অথবা অন্য যে কারণেই হোক, হেমিংওয়ের বর্ণাঢ্য জীবন বরাবরই ছিল সাহিত্য-গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। জীবদ্দশায় এক নারী থেকে অন্য নারীতে অস্থিরভাবে ছুটে চলা, পানশালায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা এবং সব শেষে আত্মহনন—তাঁর জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গের এই অস্থির মিথস্ক্রিয়া নিয়ে হেমিংওয়ের জীবনীকারেরা বিস্তর গবেষণা করেছেন, সাবেক প্রেমিকারাও লিখেছেন একাধিক বই। এসব বই ও গবেষণা থেকে হেমিংওয়ের জীবনের সারাংশ নিপুণ দক্ষতায় ছেঁকে এনেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন তাঁর নতুন গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তাঁর প্রেমিকাদের খোঁজে বইতে।
গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তাঁর প্রেমিকাদের খোঁজে
ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল;
১৮০ পৃষ্ঠা; দাম: ৫০০ টাকা।
চারটি অধ্যায়ে ব্যাপ্ত এই বইয়ে হেমিংওয়ের জীবনে নারীদের প্রসঙ্গ ছাড়া তাঁর বিভিন্ন লেখার পেছনের গল্প, যুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন নীতির সঙ্গে আদর্শিক দ্বন্দ্ব থেকে রাশিয়ান গুপ্তচর হিসেবে কাজ করার (যদিও বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়) বিভিন্ন বিষয়, আফ্রিকায় কাটানো সময় ও তাঁর প্যারিস–জীবনের নানা স্মৃতি উঠে এসেছে তথ্যসমৃদ্ধভাবে।
অসামান্য খ্যাতি ও অখ্যাতি দুই মিলে বৈচিত্র্যময় জীবন ছিল হেমিংওয়ের। মা গ্রেইস হেমিংওয়ের সঙ্গে খানিকটা গম্ভীর নেতিবাচক সম্পর্ক, মাতা-পিতার মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং প্রথম জীবনের প্রেমিকা অ্যাগনেস কুরোওস্কির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া—প্রতিটি ঘটনাই হেমিংওয়ের সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তী জীবনে চার স্ত্রী ও অসংখ্য প্রেমিকার সঙ্গে তাঁর রসায়নকে প্রভাবিত করেছিল। এ লেখকের সাহিত্যজীবনের নিবিড় অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রথম স্ত্রী রিচার্ড হ্যাডলির সঙ্গে প্যারিসে কাটানো দরিদ্র জীবন, দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন ফাইফারের সূত্রে পাওয়া আয়েশ ও খ্যাতি, তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্নের বুদ্ধিবৃত্তিক সাহচর্য এবং চতুর্থ স্ত্রী মেরি ওয়েলশের প্রেমময় সঙ্গ তাঁর সাহিত্যিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা উত্থান-পতনের সাক্ষ্য বহন করে।
চার স্ত্রী ছাড়া প্রেমিকা অ্যাগনেস, মার্জোরি বাম্প, কেটি স্মিথ, পলিন স্নোসহ আরও অনেক নারীই ভিন্ন ভিন্ন নামে উঠে এসেছে তাঁর লেখনিতে; মার্জোরিকে নিয়ে লেখা দ্য এন্ড অব সামথিং, দ্য থ্রি-ডে ব্লো কিংবা কেটির সঙ্গে সম্পর্কের রেশ ধরে লেখা সামার পিপল এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
তীব্রভাবে একজন প্রেমিক পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও বারবার বিবাহবিচ্ছেদ, ক্ষণস্থায়ী প্রেম, পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা খুব কাছ থেকে দেখা, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তৎকালীন পত্রপত্রিকায় অন্যায্য বয়ান মানসিকভাবে ভীষণ অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছিল হেমিংওয়েকে। বইটি থেকে নিন্দিত ও নন্দিত হেমিংওয়ের অনালোিচত নানা অধ৵ায়ের খোঁজ মিলবে।