বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত একুশের বইমেলা ছিল লেখক-পাঠকের ভিড়ে প্রাণবন্ত। বছরের বিশেষ একটি সময়ে আয়োজিত বইমেলাকে কেন্দ্র করে এত বেশিসংখ্যক বইয়ের প্রকাশ বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় বলে মনে হয় না। বই পড়তে এবং বই সংগ্রহ করতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এটা নিশ্চয় আনন্দের এক সময়। তবে এত বেশি লেখক আর প্রকাশকের ভিড়ে ভালো বই কিংবা সঠিক বই খুঁজে পাওয়া কষ্টকর বটে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে বিদেশের মতো বইয়ের ভালোমন্দ সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নেওয়ার ব্যবস্থা খুব বেশি নেই। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতায় হাতে গোনা যেসব বইয়ের পর্যালোচনা চোখে পড়ে, তার অধিকাংশ ফরমাশে লেখা হওয়ায় কোন বইটা আসলেই ব্যতিক্রমী কিংবা পাঠকের মনে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো, তা বুঝে ওঠা সেভাবে সম্ভব নয়, যেভাবে এটা সম্ভব অগ্রসর বিভিন্ন দেশে বইপত্রসংক্রান্ত সাময়িকী পাঠ করার মধ্য দিয়ে। ফলে পাঠক-ক্রেতাকে সেখানে অনেকাংশে নির্ভর করতে হয় বিজ্ঞাপন পাঠ করা কিংবা লোকমুখে প্রচারিত বইসংক্রান্ত ভালো-মন্দ শোনার ওপর। তার ওপর ইদানীং আবার চেপে বসেছে ফেসবুকের ‘অত্যাচার’, প্রত্যেক কবি-লেখকের জন্য যে মাধ্যম হয়ে উঠেছে আত্মপ্রচারের সবচেয়ে জুতসই এক হাতিয়ার। কবি-লেখকদের সবাই সেখানে নিজের পণ্যের প্রচারে এতটাই ব্যস্ত যে প্রচারগুণে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতো বইও যেন হয়ে উঠছে আকর্ষণীয় পণ্য। ফলে কোন বই কিনবেন আর কোন বই কিনবেন না, বিভ্রান্ত ক্রেতাকে তা নিয়ে পড়তে হয় মহাঝামেলায়।
তবে এসব সত্ত্বেও নতুন নানা মাধ্যমে ভরপুর এ সময়ে বইয়ের প্রকাশ অব্যাহত থাকাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো জরুরি।
একুশের বইমেলার ডামাডোলে অন্য যে দিকটি একেবারেই আড়ালে থেকে গেছে, তা হলো বিদেশে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কিছু বইপত্র নিয়ে আলোচনা। দেশের বাইরে প্রকাশিত কিছু বই ইদানীং গ্রন্থপ্রেমীদের নজর কাড়তে শুরু করেছে। সেই তালিকার তিনটি অন্তর্ভুক্তি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, যার একটি এর মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে এবং অন্য দুটিও প্রকাশের অপেক্ষায়।
প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা দুটি বইয়ের একটি হচ্ছে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কলম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের অপ্রকাশিত উপন্যাস আগোস্টো নস ভেমোস। গার্সিয়া মার্কেস মারা গেছেন ১০ বছর আগে, ২০১৪ সালে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে সর্বশেষ উপন্যাস নিয়ে কাজ করার সময় ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকা সেই চূড়ান্ত দিনগুলোতে শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তে তিনি এসেছিলেন যে অসমাপ্ত উপন্যাসটি প্রকাশ না করাই যুক্তিসংগত হবে। ফলে লেখা শেষ করার পর পরিবারের সদস্যদের তিনি বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরও উপন্যাসটি যেন আলোর মুখ না দেখে। এ কারণে তাঁর রেখে যাওয়া বিভিন্ন কাগজপত্রের সঙ্গে সর্বশেষ আগোস্টো নস ভেমোস-এর পাণ্ডুলিপিও ১০ বছর ধরে আলোর মুখ দেখেনি।
অবশেষে মার্কেসের দুই পুত্র—রড্রিগো গার্সিয়া ও গাঞ্জালো গার্সিয়া বার্চা পিতার মৃত্যুর প্রায় বছর দশেক পরে পাণ্ডুলিপি পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পিতার নির্দেশ সত্ত্বেও লেখকের সর্বশেষ উপন্যাস প্রকাশ না করা হলে জীবনের শেষ দিকে এসে জগৎ-সংসারকে মার্কেস কীভাবে দেখেছিলেন, সেই সত্য জানতে পারা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লেখকের ভক্ত-অনুরাগীরা বঞ্চিত হবেন। এমন সিদ্ধান্ত থেকেই উপন্যাসটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন তাঁরা এবং মূল স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পর আনটিল অগাস্ট নামে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের দায়িত্ব তাঁরা নামী প্রকাশনা সংস্থা ভাইকিংয়ের হাতে ছেড়ে দেন। ইংরেজি অনুবাদে সেই উপন্যাস ছাপা হয়ে গেছে, ১২ মার্চ ভাইকিং সেই বইয়ের বিক্রিও শুরু করবে।
কিন্তু কী আছে মার্কেসের শেষ উপন্যাসে? জীবনের শেষ দিকে লেখা অন্য কয়েকটি উপন্যাসের মতোই এটাও বিশুদ্ধ এক প্রেমকাহিনি। আনটিল অগাস্ট-এর মূল চরিত্র হলো আন্না মাগদালেনা বাখ নামের এক রমণী, প্রতিবছর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে যে একটি দ্বীপ সফর করে। ওই দ্বীপে রমণীর মুক্তি, অনুতাপ আর প্রেম-ভালোবাসার রহস্য উদ্ঘাটনের কাহিনিই আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসজুড়ে। মার্কেসের ভক্ত-পাঠকেরা এখানে সহজেই খুঁজে পাবেন তাঁদের প্রিয় ঔপন্যাসিক ‘গাবো’র সৃজনশীলতার গভীরতা, ভাষার কাব্যিক ব্যবহার, গল্প বলার জাদুকরি সামর্থ্য, সর্বোপরি মানুষকে বুঝতে পারার অসাধারণ দক্ষতার উপস্থিতি।
আলোচনার দ্বিতীয় বইটি পাঠকদের সামনে উপস্থিত হবে ১৬ এপ্রিল। নাইফ বা ছুরি নামের সেই বইয়ে সালমান রুশদি তুলে ধরেছেন আততায়ীর হাতে তাঁর আক্রান্ত হওয়া এবং তার পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতার কথা।
২০২২ সালের ১২ আগস্ট সকালে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ছুরি হাতে ছুটে আসা আততায়ীর মুখোমুখি হতে হয়েছিল সালমান রুশদিকে। হামলাকারীর পরনে ছিল কালো পোশাক এবং কালো মুখোশে মুখ ছিল ঢাকা। মারাত্মক আহত লেখককে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি ফিরে আসেন। নিজের জীবনের সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় লেখা আছে নাইফ নামে সালমান রুশদির প্রকাশিতব্য বইটিতে।
তৃতীয় যে বইটির উল্লেখ এখানে প্রয়োজন, সেটা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে টোকিওতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে লেখা বিশাল আকারের গবেষণামূলক গ্রন্থ জাজমেন্ট অ্যাট টোকিও। এ বইয়ের লেখক গ্যারি জে বাস বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে পরিচিত এক নাম, ব্লাড টেলিগ্রাম লিখে একসময় যিনি আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাস বিস্তারিত গবেষণার আলোকে নিজের বক্তব্য গ্রন্থে উপস্থাপন করে থাকেন। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে প্রকাশিত নতুন এই বইও সেদিক থেকে ব্যতিক্রমী নয়। টোকিও ট্রাইব্যুনাল নিয়ে এর মধ্যে একাধিক বই প্রকাশিত হলেও বিচারপ্রক্রিয়া চলতে থাকা অবস্থায় উভয় পক্ষের উত্থাপিত নানা রকম যুক্তিতর্কের প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে বিশেষ যে দিকটির ওপর গবেষক এখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন, তা হলো, মূল অপরাধী হিসেবে জাপানের সম্রাটকে বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরে রাখা আদৌ যুক্তিসংগত ছিল কি না। সেদিক থেকে বলতে হয় যে নতুন এক অবস্থান থেকে বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর লেখকের আলোকপাত অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।