বাংলাদেশ, যে বর্তমানময়তায় এখন বাস্তব আর উপস্থিত, তা এক দিনের সৃষ্ট বিষয় নয়; এক দীর্ঘ রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে ‘বর্তমান বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রের চরিত্রের দিকে তাকালে মনে হবে যেন, এই রাষ্ট্র তার পুরোনো রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক চরিত্রের ভেতরেই আবদ্ধ; পরিবর্তন তেমন হয়নি! কিন্তু এরও তো একটি যাত্রাবিন্দু আছে, আছে সূচনা। এই সূচনার প্রথম বিন্দু কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, সেই আলাপ-আলোচনা বেশ দুষ্কর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় একেক ব্যক্তির জন্য। কিন্তু যে ব্যক্তি তাঁর কালে এসব বিষয় নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই ব্যক্তির আলাপ-আলোচনা অবশ্যই সেই সময়ের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ধারণাকে বেশ ভালোভাবে জানা-বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হবে।
আবুল মনসুর আহমদ এই ধারণায় আবদ্ধ হয়ে বেশ কিছু বই লিখেছেন। তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের জগতে রম্যলেখক হিসেবে। বিষয়টিকে অনেকে কেবলই হাস্যরসের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তের দপ্তর পড়ে কেউ কি বলতে পারবেন, তিনি কেবল তাতে হাস্যরস সৃষ্টি করে গেছেন? না, হাস্যরসের ভেতর দিয়ে তিনি সামাজিক সমস্যাকে উপস্থাপন করেছেন। আবুল মনসুর আহমদের বেলায়ও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। বঙ্কিমচন্দ্র যে সমাজের বুকে স্যাটায়ার-চাবুক হাঁকিয়েছেন, সেই একই চাবুক হাঁকিয়েছেন মনসুর আহমদ, তাঁর রসরচনায়। আর এই ধারায় বিশেষ তাঁর গালিভরের সফরনামা।
আদি ও আসল গালিভরের সফরনামার লেখক জোনাথন সুইফট। তিনি যে ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনা করেছিলেন, সেই ভ্রমণবৃত্তান্তে দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানুষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ করেছেন। এই একই বিবেচনায় মনুসর আহমদ লিখেছেন বাংলাদেশ আর দেশভাগ-পূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সংকট নিয়ে। এ বইয়ের ভূমিকা-প্রস্তাবে লেখক যা বলছেন, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি আলাপে আসতে পারে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসির মাধ্যমে। শওকত ওসমান আইয়ুব শাহীর আমলে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের বিষয়াদি তুলে ধরেছেন এখানে। কিন্তু তিনি বলছেন, উপন্যাসটি রচিত হয়েছে আরব্য রজনীর হারিয়ে যাওয়া পাতার অনুপ্রেরণায়। তবে আমাদের বুঝতে অসুবিধা না হলেও আইয়ুব খানের সরকার উপন্যাসটির মর্মার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। ফলে তাঁকে দিয়ে দেয় সেই সময়ের সবচেয়ে বড় ‘আদমজী পুরস্কার’। তেমনি গালিভরের সফরনামা বইটি রচনার ক্ষেত্রে মনসুর আহমদও এই একই পদ্ধতি-প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছেন।
এতে গ্রন্থভুক্ত ১১টি লেখার প্রথমটি ছাপা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে; আর শেষটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস পাঠ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সময়কাল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিকতার জন্য নানা কারণে বেশ সংকটময়। ১৯৩৭ সালের ঐতিহাসিক পটভূমি বিচার-বিবেচনা করতে গেলে উপলব্ধি করা সম্ভব হয় এই সত্য। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল স্পিরিট বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে সংকটকালীন একজন লেখক-বুদ্ধিজীবীর দায় কতটুকু এবং কীভাবে তা পালন করা যেতে পারে, এই বইয়ের লেখাগুলো তার বাস্তব উদাহরণ।
এর প্রথম লেখা: ‘গালিভরের সফরনামা’ই আদতে বইটির অন্যান্য লেখার সারাংশ হতে বাধ্য। এই লেখায় মনসুর আহমদ দুটি অঞ্চলের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন এবং দুই অংশের তুলনা করেছেন। ‘বাউনের দেশ’ অংশে এমন এক রাষ্ট্রের কথা তিনি স্পষ্ট করেছেন, যে অংশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিয়ন্তাব্যক্তিদের বিষয়াদিও বিশেষভাবে ইতিবাচক চিন্তার ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে। আর ‘দেউ-এর দেশে’ নামের অংশে তিনি এমন এক রাষ্ট্রের আলাপ তুলেছেন, যে দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা মিলে যায় সফরকারী ব্যক্তি, অর্থাৎ গালিভরের সঙ্গে।
কিন্তু কে এই গালিভর? যার অভিজ্ঞতার বাস্তবতা মিলে যাচ্ছে ‘দেউ-এর দেশে’? পাঠকের বুঝতে বাকি থাকবে না যে ‘দেউ-এর দেশ’ মূলত বাংলাদেশ; অর্থাৎ স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র। একটি লেখা নিয়ে আলাপ করা হলো এই আলোচনায়। কিন্তু আগে যে কথা বলা হলো, একটি রাষ্ট্রের প্রায় সবকিছু এ লেখার ভেতরে আছে। এই বইয়ে তেমনি রাজনীতি, নেতিবাচক রাজনীতিতন্ত্র, শিক্ষাব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন, জনপরিসরে জনগণের মনস্তত্ত্বসহ নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে। আর এসব বিষয়ের প্রায় প্রতিটি পচে-গলে একাকার হয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। মনসুর আহমদ সেই দুর্গন্ধকেই যেন তাঁর লেখনীর দ্বারা লিখিত লেখাগুলোর মাধ্যমে সুবাসিত করে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। আনন্দ-হিল্লোলে ভরিয়ে তুলেছেন। বইয়ে যেসব সমস্যা মনসুর আহমদ তাঁর নিজ উপলব্ধির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছেন, সেই পরিস্থিতি আজও বাংলাদেশে বিদ্যমান। ফলে পাঠক এই বই পড়ে সমকালীন সমস্যাই হাস্যরসের ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন।
সোহানুজ্জামান
গালিভরের সফরনামা
আবুল মনসুর আহমদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ১৩৬ পৃষ্ঠা;
দাম: ৩২০ টাকা।