প্রথার বাইরে দাঁড়িয়ে
প্রতিষ্ঠানের প্রথা, নিয়ম, রীতি ওয়াজউদ্দিন—যিনি সবার কাছে পরিচিত ‘মামুন’ নামে—টের পান। কিন্তু মানতে পারেননি। কেন তিনি ছবি আঁকেন, সে রকম ভাষ্য তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় না। কুড়িয়ে পাওয়া কাগজ, জঞ্জাল, পেরেক, লেদ মেশিনে ব্যবহৃত লোহার টুকরা, বেয়ারিংয়ের চাকায় ব্যবহৃত বল, ছবির জমিনে জুড়ে দিয়েছেন। রং আর আকৃতির বিস্তৃতি ছবির জমিনে সংঘাত তৈরি হয়। উষ্ণ রং আর আকৃতির সঙ্গে রেখার সংযোগ ক্যানভাসের বাইরে দৃষ্টি টেনে নিয়ে যায়। একরকম সংঘাত, টানাপোড়েন আমরা ওয়াজউদ্দিনের কাজে দেখতে পাই। পুরান ঢাকার বংশালে তাঁর আদি নিবাস। এখনো তিনি ওই এলাকায় বসবাস করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী হওয়ার যে পথ, সেদিকে তিনি হাঁটেননি। পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতায় এমন একাডেমির খোঁজ ছিল না। কালের আবর্তে তাই পৈতৃকসূত্রে পাওয়া লেদ মেশিনের কারিগর হয়েই বেড়ে ওঠেন। তাঁর আঁকা এই ছবি প্রদর্শিত হওয়ার মতো কি না, সে প্রশ্ন না করে তিনি চারুকলা অনুষদের সামনে ২০১৭ সালে ছবির বান্ডিল রেখে যান। শিল্পচর্চার প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা ছাড়া মামুনের এই পথচলা ভিন্ন জীবনদৃষ্টির সন্ধান দেয়।
এ মাসের ১৬ তারিখে কলাকেন্দ্রে শেষ হয়েছে ওয়াজউদ্দিনের প্রদর্শনী। এখানে মোট কাজ ছিল ২১টি। বেশির ভাগ কাজের শিরোনাম থাকলেও বেশ কিছু কাজে শিরোনাম নেই। এতে ছবির গড়নের ভাষায় যে ভিন্নতা তৈরি হয়েছে, এমন মনে হয়নি। নির্দিষ্ট কিছু রঙের প্রলেপের বাইরে এসে অপ্রচলিত রঙের ব্যবহার শিল্পীর কাজকে আলাদা মনে হয়েছে। ছবির পুরো জমিনে আকৃতি ছড়িয়ে দিয়ে রঙের প্রবাহে গতি তৈরি করেন তিনি। এতে তাঁর উদ্ভ্রান্ত মন কিছুটা শান্ত হয়। ছবির চারপাশ ঘিরে থাকা গতিশীলতা শিল্পী নিজেকে প্রকাশ করার অবস্থা বোঝা যায়।
সহজলভ্য কাটুনশিট, লোহা-লক্কড়ের টুকরো, পুরোনো ম্যাগাজিনের পাতা কোলাজ পদ্ধতিতে ছবির জমিনে জুড়ে দেন ওয়াজউদ্দিন। জমিন তৈরিতে শ্রম দেন অনেকটা নির্মাণশ্রমিকের মতো। ফলে, তাঁর জমিনে পরিশীলিত টান টান রূপ তৈরি হয়, ঠিক এমন বলা যায় না, কিন্তু অধিক যত্নবান হয়েই তিনি বিচ্ছিন্নতার সুর সৃষ্টি করেন। সমকালের আর্তি-চিৎকারে একাকার হয়ে আছে তাঁর ক্যানভাস। দ্রোহ, ক্ষোভ, উত্তাপ, সবুজ ছায়ার আকাঙ্ক্ষা, মানুষ আর প্রকৃতিতে সখ্য—সব ভাবনা তিনি একসঙ্গে দেখাতে চান। তাই ছবির কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে গিয়ে দর্শকের দৃষ্টি ছড়িয়ে যায় পুরো ক্যানভাসে।
দুই রকমের চিত্রতল নির্মাণ করেছেন এ চিত্রকর। প্রথমত, ফেলনা পুরু বক্সবোর্ডের ওপর আরও কাগজ জুড়ে দিয়ে একধরনের ইমেজ তৈরি। দ্বিতীয়ত, ছবির জমিনে রং, বলপেন, কাগজের সঙ্গে একেবারে বিপরীত মাধ্যম লোহার টুকরো, পেরেক, সিসার তৈরি বল জুড়ে দেওয়া। বিষয়ের সঙ্গে মাধ্যম যুক্ত করার চেষ্টা দেখা যায় কিছু কাজে। অন্যদিকে কোনো কোনো কাজে বলপেনের রেখা রঙের প্রলেপ কোথাও কোথাও অস্পষ্ট হয়ে লুকিয়ে থাকা ইমেজের দৃশ্যাবয়ব তৈরি করে।
বিষাদময় উত্তপ্ত এই শহরের ক্লান্তি এসে ভর করেছে ওয়াজউদ্দিনের কাজে। তাঁর ফ্রেমহীন আর ফ্রেমবন্দী—দুই রকম কাজ নিয়েই দর্শকের মনে তৈরি হতে পারে প্রশ্ন। সবশেষে বলা যায়, এই ঠাসবুনটের শহরে ওয়াজউদ্দিন যা দেখতে পান, সেটিই হাজির করেন নিজের ছবিতে। তবে তার সব যে প্রথাগত রীতিতে নির্মিত হবে, এমন কোনো কথা নেই।