প্রতিকৃতি ও কাইয়ুম চৌধুরী
জীবদ্দশায় আজস্র মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। তবে প্রতিকৃতি কি কেবল এঁকে ফেলার বিষয়?
‘হুমায়ূনের কতগুলো ভালো ছবি খুঁজে দিতে পারো?’ আমি বললাম, কোন হুমায়ূন—হুমায়ুন আজাদ না হুমায়ূন আহমেদ?’ তিনি বললেন, ‘আহমেদ।’ এর প্রায় সাত–আট দিন পরের কথা। তিনি বেশ স্বাভাবিক স্বরেই বললেন, ‘হয়ে গেছে। দরকার নেই।’ অনেক দিন পর তাঁর কাজের ফাইল ঘেঁটে অন্তত কুড়িটি বিভিন্ন ফটোগ্রাফ পেলাম হুমায়ূন আহমেদের। তাদেরই একটি ব্যবহার করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর হুমায়ূন আহমেদকে আঁকতে।
কাইয়ুম চৌধুরী গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু অন্তর্জালে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখুন তো, তাঁর ওপর যা কিছু তথ্য তার সবই প্রায় তাঁর শিল্পী (আর্টিস্ট/পেইন্টার) পরিচয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অনেকটা ফুটনোটের মতোই তাঁর গ্রাফিক ডিজাইনসংক্রান্ত কাজের কথাগুলো এককোণে জায়গা পায়। কাইয়ুম কি প্রথমত পেইন্টার নাকি গ্রাফিক ডিজাইনার—তর্কে না গিয়ে এটি অন্তত বলা যায়, তাঁর গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কাজটি তেমনভাবে হয়নি। এই লেখায় তাই আমরা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর পরিবর্তে গ্রাফিক ডিজাইনার কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে একটু ভাবব। আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রতিকৃতি (পোর্ট্রেট) ডিজাইনার কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়েই এই লেখা।
‘আমার’ মুখটি আমার নিজের। কিন্তু আমার এই মুখটি আমি নই। আমার ‘আমি’ গড়ার কারিগর আমার ‘মন’। আয়নার সামনে দাঁড়ানোর আগপর্যন্ত এই ‘মুখ’টিকে আমি দেখতে পাই না, অন্যরা এর মাধ্যমেই আমাকে চেনে–জানে। আর আঁকিয়ে যখন এঁকে দেন আমাকে, তখন আমার এই মুখ আর মনের সঙ্গে মিশে যায় আঁকিয়ের ভাবনাও। শিল্পোকরণের আঁচড় এবার অন্যের চোখে আমি কেমন, সেটিও তাই জানিয়ে দেয়।
পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে এই তিনটি দিকই হয়তো ভেবে দেখলে চলে। গ্রাফিক ডিজাইনে চলে না। গ্রিক হেলেনিস্টিক আর্টের রিয়ালিজমের গণ্ডি ছাপিয়ে যেতে শিল্পজগৎ অনেক ক্ষেত্রে এখনো অপারগ। গ্রাফিক ডিজাইন এতে যোগ করেছে চতুর্থ মাত্রা— ‘প্রয়োজন’। গ্রাফিক ডিজাইনার প্রতিকৃতি আঁকেন কোনো একটি তথ্য মানুষকে জানানোর প্রয়োজনে। পত্রিকার বিন্যাস, বইয়ের অঙ্গসৌষ্ঠব, কবিতার অলংকরণ, গল্পের চিত্রায়ণ, পণ্যের বিজ্ঞাপন কিংবা অনুষ্ঠানের পোস্টার—এই সবকিছুই শৈল্পিকভাবে—কখনো সরল, কখনো কঠিন করে মানুষের সামনে নিয়ে আসার কাজটি ডিজাইনারের। শিল্পীর মতো পু্রোপুরি স্বাধীন তিনি নন, পণ্যের প্রয়োজনে রূপারূপের পরিবর্তন, পরিমার্জন অথবা পরিবর্ধন তিনি করেন।
গ্রাফিক ডিজাইনারের আঁকা প্রতিকৃতি তাই পেইন্টারের আঁকা প্রতিকৃতি নয়। তবে বড় শিল্পী এই বিভাজনরেখার এপার-ওপার অনায়াসেই হতে পারেন। কাইয়ুম তেমন এক ক্ষণজন্মা শিল্পী-ডিজাইনার।
শুরু করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের প্রতিকৃতির গল্প দিয়ে। ২০১২ সালের গ্রীষ্মকালের ঘটনা। হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কের হাসপাতালে বেশ অসুস্থ। পিটসবার্গ শহরে বসে কাইয়ুম খোঁজ নিয়েছেন হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থার। আর তার কিছুদিন পর সানহোসে শহরে পৌঁছে তিনি শুনলেন লোকান্তরিত হয়েছেন হুমায়ূন। আমাকে বললেন, ‘বেশ কালারফুল একটা লোক ধুম করে চলে গেল।’ নভেম্বরেই প্রথমা প্রকাশন প্রথম আলোয় প্রকাশিত হুমায়ূনের নানা বিষয়ের লেখাপত্র নিয়ে প্রকাশ করল বসন্ত বিলাপ নামের বইটি। লেখাগুলো হুমায়ূনের ‘কালারফুল’ জীবনজিজ্ঞাসারই রূপায়ণ। আর তাই কাইয়ুমের আঁকা প্রতিকৃতিতে ধরা দিলেন কালারফুল হুমায়ূন আহমেদ—তাকিয়ে আছেন সুদূরপানে, আর তাঁর লেখার হাতটির ওপর ভর দিয়ে আছে তাঁর গ্রীবা। আমি শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হুমায়ূন আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন? কাইয়ুম বললেন, ‘একটু ভাবো তো, এই বইটি নানাজন নানা সময়ে নানাভাবে দেখবে। তুমি তোমার পড়ার টেবিলে রাখবে, ও বাড়ির মেয়ে তার বিছানার পাশে রেখে চোখ মুছতে মুছতে পড়বে। কথা হলো, হুমায়ূন চলে যাওয়ার পর এদের সবাই এই ছবির সামনে “স্টিল” আর “সাইলেন্ট”। হুমায়ূনের দূরের চাহনি ওদের মনে বসন্তের চলে যাওয়ার বিলাপেরই সূচনা করবে না? কালারফুল কিছু একটার স্বপ্ন কালারফুল এই মানুষটি দেখাচ্ছেন—এটি ভাববে না?’
কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতিকৃতিশিল্পে নিজের মনের সঙ্গে জনমানসের মনের আকাঙ্ক্ষাকে মেলানোর যুদ্ধটাই করেছেন চিরকাল। তবে সর্বাগ্রে যাঁকে আঁকা হচ্ছে তাঁর ‘সংজ্ঞা’টি তিনি নিজের মতো খুঁজেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাই কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে ‘কালারফুল’, কবি সুফিয়া কামাল ‘সাবলাইম’, সাদ্দাম হোসেন হলেন ‘পতিত’, গ্রেগরি পেক ‘নায়ক’, নজরুল কখনো ‘বিদ্রোহী’ কখনো ‘ট্র্যাজেডি’, সৈয়দ শামসুল হক ‘বন্ধু’, শামসুর রাহমান ‘নিপাট কবিবর’, মোহাম্মদ কিবরিয়া ‘অমায়িক শিল্পী’, জয়নুল আবেদিন হলেন ‘শিক্ষক’। আর সবকিছু ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু হলেন ‘নেতা’ ও ‘পিতা’। কতবার কত প্রয়োজনে এঁদের কতরকমভাবে এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী, সেটি যাঁদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তাঁরাই জানেন।
প্রতিকৃতি আঁকার জন্য ছবি বাছাই করতেই তাঁর যেত অনেকটা সময়। তারপর ট্রেসিং এবং সেখান থেকে পাওয়া সুরুওয়াতের ড্রইংয়ের কত কত পরিমার্জনা তিনি করতেন, যেগুলো ভালো লাগত না হাত দিয়ে মুচড়ে ফেলে দিতেন, দু–চারটি যা ভালো লাগত রেখে দিতেন কিছুদিন। তারপর একটি বেছে নিয়ে করতেন কালার স্কিমের প্ল্যান। পুরো প্রক্রিয়াটি করতে মনে মনে কত পরিকল্পনা করতে হতো, এরপর দম নিয়ে কাজটা করে ফেলা—কী কঠিন দ্বন্দ্বমুখর সময়! তার ওপর সবশেষে চিন্তা, ছাপা ও ছাপার মান নিয়ে। এ দুটির জন্যই নানা কিছুর নিরীক্ষা করা থেকে বিরত থাকতেন গ্রাফিক ডিজাইনার কাইয়ুম চৌধুরী। উপকরণ আর ছাপার প্রযুক্তিগত দিকটি ভালো বুঝতেন বলেই তাঁর প্রতিকৃতিগুলো গ্রাফিক ডিজাইনের ছাত্রদের জন্য শিক্ষণীয়। প্রচ্ছদে যেমন প্রতিকৃতি হবে, পোস্টারে তেমন হবে না—এটি সহজ কথা, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর প্রকাশ কেমন, তা কাইয়ুমের প্রতিকৃতিশিল্পের পাঠ নিয়ে বোঝা যায়।
শিল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই আমরা একে জীবনের চেয়ে উঁচু কিছু ভেবে বসি। কোনো ধনীর ঘরে ঝুলিয়ে রাখা পেইন্টিং কিংবা সাজানো ভাস্কর্য অথবা টিকিট কাটা জাদুঘরের শিল্পসামগ্রী সাধারণের থেকে কত দূরে? গ্রাফিক ডিজাইন শিল্প ও জনমানসের দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করে। তুলুস লুত্রেক তাই এঁকেছেন লিথোগ্রাফির পোস্টার, অঁরি মাতিস চিত্রিত করেছেন কবিতা, পিকাসো জন্ম দিয়েছেন অসাধারণ গ্রন্থচিত্রণের। এসবই শিল্পকে সাধারণের আয়ত্তে আনার প্রয়াস। কাইয়ুম চৌধুরীর গ্রাফিক ডিজাইনারের সত্তা এই কাজটিই করতে চেয়েছে বারবার। প্রয়োজনে প্রতিকৃতির মানুষটিকে দেখানোর দিক নিয়ে খেলেছেন, কখনো তাঁর চোখ নিয়ে মেতেছেন, ডিজাইনের প্রয়োজনে ব্যাকগ্রাউন্ড নেড়েচেড়ে দেখেছেন, কখনোবা প্রচ্ছদের শিরোনামের ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে সংগতি রাখতে প্রতিকৃতিকে করে তুলেছেন অতি সরল, আর চরিত্রের দ্বন্দ্ব বোঝাতে খেলেছেন মাধ্যম নিয়ে—কখনো কালি–কলম, কখনো কালি–তুলি বা অন্য কোনো শিল্পোপকরণ। যাঁদের এঁকেছেন বারবার, এঁদের প্রায় সবাইকেই একাধিকবার দেখার, পড়ার, জানার এবং অনেকের সঙ্গেই মেশার সুযোগ ছিল বলেই তাঁর প্রতিকৃতিগুলো গড়ে উঠেছে ব্যক্তি ও তাঁর মনন এবং কাইয়ুমের চোখে তাঁদের ফেলে যাওয়া ছাপের মিশেলে। একটি মানুষকে কীভাবে দেখব আর তারপর কীভাবে দেখাব—এটি জানতে আমাদের বারবার ফিরতে হবে গ্রাফিক ডিজাইনার কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে।