স্মৃতি যখন প্রতিরোধ

গুমের শিকার হওয়া একটি পরিবারের হাহাকারছবি: মোশফিকুর রহমান জোহান

প্রায় ১০ বছর ধরে সেলিম রেজা পিন্টুর ঘরের প্রতিটি জিনিস একই রকম করে রাখা। বরফের মতো জমে যাওয়া সময়ের একটি বিষণ্ন ছবি। ১১ ডিসেম্বর ২০১৩। সেদিন তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুঃসহ অপেক্ষায় এতগুলো দিন গেল।

তবু প্রতিটি কড়া নাড়ার শব্দে পুরো পরিবার ছুটে যায় দরজায়। এই বুঝি তিনি ফিরেছেন। সেদিন থেকে আজ অব্দি তাঁর কোনো খোঁজ নেই। পিন্টু গুমের শিকার। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাপ্তরিক তথ্যমতে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে এমন সাত শর বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা কত কে জানে!

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনীকক্ষে চলছে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত তরুণ আলোকচিত্রী ও নৃতাত্ত্বিক গবেষক মোশফিকুর রহমান জোহানের প্রদর্শনী ‘গুম: জান ও জবান’। ১৫ বছর ধরে গুম হয়ে যাওয়া ১৭ জন মানুষ এবং তাঁদের পরিবারগুলোর না–বলা কথা ও আটকে থাকা আলোকচিত্রমালা।

বিগত সরকারের আমলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জোহান নিজ উদ্যোগে গুম হয়ে যাওয়া মানুষ এবং তাঁদের পরিবারগুলোর দুর্দশাময় সংগ্রাম, বেঁচে থাকার সব আশা বা হতাশা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। রাষ্ট্রীয় খবরদারি ও সামাজিক হুমকির কারণে গুম নিয়ে কাজ করা আলোকচিত্রীর জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছিল। বারবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন।

জোহান গবেষণার তথ্য ও আর্কাইভ নানা মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ডকুমেন্টারির ধাঁচে। তিনি প্রদর্শন করেছেন নিজের তোলা আলোকচিত্র, পরিবারগুলোর কাছ থেকে সংগৃহীত পেপার কাটিংয়ের ওপরে লেখা সন্তানের আকুতি, হতবিহ্বল স্ত্রীর ডায়েরির পাতার অনুলিপি, ১৭টি সংক্ষেপিত সাক্ষাৎকারের অডিও, সিসিটিভি ফুটেজে একটি অপহরণের রোমহর্ষ ভিডিও।

গ্যালারিতে আলোকচিত্রগুলো দীর্ঘ দুই সারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। গুম নামক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উন্মোচিত স্বরূপ দেখে প্রতিটি ছবির সামনে দর্শককে থমকে দাঁড়াতে হচ্ছিল। নান্দনিকতা ছাড়িয়ে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে রাজনৈতিক সচেতনতা, গুমের নানা স্তরের বয়ান ও স্মৃতির দলিলায়নই এই প্রদর্শনীর শক্তি।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আয়োজিত প্রদর্শনীটি নিজেই এক অন্ধকার নিরুদ্দেশ সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে। সরকার পতনের পর গুম হয়ে যাওয়া সব মানুষ বেরিয়ে আসবে, বলে স্বজনদের প্রতীক্ষার শেষ হয় না। কিন্তু গুটিকয় মানুষ ফিরে আসায় তা আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

এই প্রদর্শনীর দেয়ালে দেয়ালে লেখা ‘মায়ের ডাক’–এর করুণ আকুতি: ‘গুম শব্দটা আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়েছে বাবা’ কিংবা ‘বাবা, আমরা তোমার অপেক্ষায় আছি’।

বাংলাদেশের এই নতুন বাস্তবতায় জোহানের সাহসী আলোকচিত্র আর কথামালা কি আয়নাঘর ভেঙে রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার মানুষদের ফিরিয়ে আনতে পারবে?