প্রদর্শনশালার পুরোটা জুড়ে টকটকে লাল। চশমা ছাড়া স্পষ্টভাবে কিছু দেখতে পাই না। চশমা ছাড়াই টকটকে লাল দেয়াল আর প্যানেলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, ঘরটিতে জুলাই নেমে এসেছে।
মাস পেরিয়ে গেলেও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে জুলাই মাস শেষ হয়নি। স্বৈরাচারবিরোধী গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়া আন্দোলনে যত দিন রক্ত ঝরবে, দাবি পূরণ হবে না, তত দিন চলবে জুলাই—এমন আওয়াজই ধ্বনিত হয়েছে প্রতিবাদী মানুষের মুখে মুখে। সেই রক্তাক্ত জুলাইকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দৃক পাঠ ভবনের গ্যালারিটি। দেয়ালে-প্যানেলে দেড় শর বেশি বিদ্রোহী কার্টুন।
আমাদের নজর কাড়ল মেহেদী হকের আঁকা পলায়নরত স্বৈরাচারীর কার্টুন। স্বৈরাচার পেছনে ফেলে যাচ্ছে তাঁর বহুল ব্যবহৃত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ লেখা দাবার ঘুঁটি। পাশেই জনতার উদ্যত হাত। মেহেদী হক আঁকার সময় কী ভেবেছিলেন জানি না। তবে দর্শক হিসেবে এমন উত্তাল সময়ের উত্তাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কার্টুনের মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলোর সামনে দাঁড়ানোর ‘অধিকার’ ফিরে পাওয়ায় দর্শকদের মনে আনন্দ জেগেছে। আনন্দের আরও বাড়ল পরিচিত কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, মেহেদী হক, নাসরীন সুলতানা মিতুর পাশাপাশি নবীনদের কার্টুন দেখে।
কার্টুনের পাশেই গ্যালারির ডান দিকে আন্দোলনের সময় আঁকা দেবাশিস চক্রবর্তীর পোস্টারে সজ্জিত প্যানেল। বিদ্রোহের মন্ত্রে জেগে ওঠা সারি সারি পোস্টার। জুলাই মাসের প্রথম দিকে এগুলো দেখা গিয়েছিল ফেসবুকে। মাত্রই তো কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। অথচ প্রবল জুজুর ভয়ে ‘হুকুমের আসামি’ লেখা দেবাশিসের সেই পোস্টার নিজেদের ইনস্টাগ্রামে শেয়ার দেওয়ার সময়ও সবার মনে ছিল ভয়। মুক্ত গ্যালারির এক কোনায় দাঁড়িয়ে আজ সেই একই পোস্টার দেখে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।
একটা প্রশ্নও অবশ্য মনে জেগে উঠেছে। বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট নেটওয়ার্ক, দৃক আর ই-আরকির সম্মিলিত এই আয়োজনের নাম ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’। কিন্তু দেবাশিস চক্রবর্তীর এসব পোস্টার আর অনেকগুলো প্যানেলে কিছু সচিত্রকরণ দেখে মনে হলো প্রদর্শনীর থিম আর নামের মধ্যে সংযোগ আছে তো?
বিকেলে প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখা গেল তা লোকে লোকারণ্য। ঢুকতে না পেরে ক্যাফেতে বসে খুশিমনেই অপেক্ষা করতে হলো। সন্ধ্যায় প্রদর্শনীর সময়সীমার প্রায় শেষ দিকে আবার গিয়ে দেখা গেল, ভিড় তখনো কমেনি। দর্শক কার্টুন দেখছেন, ছবি তুলছেন। কেউ কেউ সঙ্গীকে শোনাচ্ছেন রক্তাক্ত জুলাইয়ে কেমন কেটেছে তাঁদের দিন। প্রদর্শনী দেখার ফাঁকে ফাঁকে দর্শকদের এসব অভিজ্ঞতাও ছিল শোনার মতো। দর্শক শুধু বিদ্রোহের কার্টুনই দেখেননি, সদ্য বিদ্রোহ থেকে ফিরে এসে এই ‘দেখা’র মধ্য দিয়ে সেই বিদ্রোহের স্মৃতিচারণাও করেছেন।
এই প্রদর্শনীর কার্টুনগুলো ইতিহাসের দলিল লিখতে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
গ্যালারির একটি অংশে ভিড় বেশি। সেখানে ছাদ থেকে সুতা বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু পানির বোতল। বোতলের গায়ে লেখা ‘মুগ্ধ’। ১৮ জুলাই আন্দোলনের মিছিলে সবাইকে পানি খাওয়াচ্ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। সেই মিছিলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে রচিত স্থাপনাশিল্পটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কানে আসে আন্দোলনের দিনগুলোতে তৈরি বিদ্রোহী র্যাপ গান, ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ!’
এই প্রদর্শনীর কার্টুনগুলো ইতিহাসের দলিল লিখতে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমরা যাঁরা এত মৃত্যু, এত রক্ত, এত অনিশ্চয়তার স্মৃতি মাথায় নিয়ে নিত্যদিনের ব্যস্ততায় নিজেদের অভ্যস্ত করতে এখনো হিমশিম খাচ্ছি, তাঁদের জন্যও আয়োজনটি ছিল ভীষণ প্রয়োজনীয়। প্রদর্শনী দেখতে দেখতে আমরা সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া বিদ্রোহী দিনগুলোকে স্মরণ ও চারণ করি। কে না জানে ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করতে চাইলে তা কত জরুরি।
তাবাসসুম ইসলাম