নিপীড়ক রাষ্ট্রের নির্মম ব্যবচ্ছেদ

ক্লোজেট ল্যান্ড নাটকের দৃশ্য

নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি সম্মতি উৎপাদন। সে কারণে সর্বত্র তাকে ভয়ের সংস্কৃতি জারি রাখতে হয়। বিগত স্বৈরাচারের আমলে বাংলাদেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে, কিন্তু মুখ ফুটে বলার ভাষা ছিল না। কিছু কথা হয়েছে প্রতীকী উচ্চারণে। ক্লোজেট ল্যান্ড তেমনই একটি প্রযোজনা। ‘অপেরা’ অপেক্ষাকৃত নবীন নাট্য সংগঠন। গত বছরের ডিসেম্বরে তারা মঞ্চে এনেছে তাদের ১৫তম প্রযোজনা রাধা ভরদ্বাজ রচিত, নাহিদ স্মৃতি অনূদিত ও সাজ্জাদ সাব্বির নির্দেশিত এ নাটক।

নাটকের বিষয় মানবাধিকার। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাট্যকার রাধা ভরদ্বাজ নিজে এর চলচ্চিত্রায়ণে (১৯৯১) নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর বিপণনে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে এটি মঞ্চায়নের যে ক্ষেত্র তৈরি করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে নাটকটি মঞ্চে এল অপেরার হাত ধরে।

নাটকটি যখন মঞ্চে এল, তখন দেশের রাজনীতি ক্রান্তিকাল পার করছে। ভয়ের সংস্কৃতি তুঙ্গে। ক্লোজেট ল্যান্ড হাজির হলো ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণের আদ্যোপান্ত নিয়ে। নাটক নিয়ে আলোচনা হয়নি; কারণ, নারী ও জেন্ডারের প্রশ্নে, ক্ষমতাকাঠামোর অনুসারী রাজনীতি ও শিল্পচর্চার প্রশ্নে শিল্পাঙ্গন যেভাবে সরকারের অংশীদার হয়ে উঠেছিল, নাটকটি সেখানে ছিল চপেটাঘাতের মতো। ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর নাটকটির পরপর দুটি প্রদর্শনী হয়ে গেল মহিলা সমিতি মিলনায়তনে।

নাটকের কাহিনি একজন রাজনৈতিক বন্দীকে রিমান্ডে নির্যাতনের ঘটনাকে ঘিরে। নাম না–জানা এক শিশুসাহিত্যিক একটি ছোট্ট কক্ষে মুখোমুখি হন নাম না–জানা আরেক জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তার। শুরু হয় বাঘবন্দী খেলা। প্রশ্নকর্তা আর বন্দী সাহিত্যিকের কথোপকথন গভীরে যেতে যেতে গভীরতর সব প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। আপাতনিরীহ শিশুতোষ রচনাকে রাষ্ট্র ভয় পায়। সন্দেহ করে, প্রতীকের আশ্রয়ে তা ক্ষমতাকাঠামোকে আক্রমণ করছে কি না। সে সন্দেহ প্রমাণ করতে রাষ্ট্র উঠেপড়ে লাগে। ক্লোজেট ল্যান্ড–এর রচয়িতাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে আসে।

জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তা এখানে রাষ্ট্রেরই চেহারা। কাঠামোর দাস হয়ে একজন তরুণ কবি ও পিয়ানিস্ট কী করে ভয়ংকর নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তার বয়ান আছে এ নাটকে।

ক্লোজেটে বন্দীর কল্পিত দুনিয়ায় জামাকাপড়ই নিরাপদ সঙ্গী। আর বিপদের বন্ধু ফ্রেন্ডলি রুস্টার। নাট্যকার নারী বলেই সম্ভবত এই নাটক অনেক অদেখা নির্মম ছবি অকপটে তুলে ধরেছে। কল্পনা ছাড়া মেয়েটি লুকাবে কোথায়? বাস্তবের দুনিয়ায় ফ্রেন্ডলি রুস্টার মিলবে কোন নারীর?

নাহিদ স্মৃতি ও সাজ্জাদ সাব্বিরের সু-অভিনীত দুই চরিত্রের নাটকটিতে উঠে এসেছে সমাজের আপাতস্থিতাবস্থার অন্তরালে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্লেদ।

নাটকটির আয়োজন মিনিমালিস্ট। বিনোদনমুখী সন্ধ্যায় রাষ্ট্রের ব্যবচ্ছেদধর্মী ক্লোজেট ল্যান্ড ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে।

হুমায়ূন আজম