কাজী আবদুল বাসেতের চিত্রশিল্পের দিকে তাকালে একপ্রকার নরম, কোমল আর রমণীয় মাটির স্পর্শ পাওয়া যায়। উদগ্র বাসনার উদ্দামতার বদলে তাঁর শিল্প দর্শককে কোনো নির্লোভ সৌন্দর্যের আনন্দময় ভুবনে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে রূপ আর অরূপের সাধনায় মগ্ন থাকেন তিনি। ব্যাপৃত থাকেন অবয়ব আর নিরবয়বের আরাধনায়। এভাবে তাঁর চিত্রমালা হয়ে ওঠে মূর্ত আর বিমূর্তের যুগলবন্দী। সেখানে নিয়ত উঁকি দেয় পূর্ব ও পশ্চিমের বিপরীতধর্মী ভাবলোক আর শিল্পসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু পরিণামে তাঁর শিল্পের জমিন বৈপরীত্যের দ্বন্দ্বে জীর্ণ হওয়ার অবকাশ পায় না, সমন্বয়ের আত্তীকরণে হয়ে ওঠে সাবলীল ও প্রাণময়।
ঢাকা থেকে শিকাগো
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার চারুকলায় কাজী আবদুল বাসেত (১৯৩৫-২০০২) ছিলেন চতুর্থ ব্যাচের ছাত্র। প্রথম ব্যাচে ছিলেন আমিনুল ইসলাম; দ্বিতীয় ব্যাচে কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক; তৃতীয় ব্যাচে সৈয়দ জাহাঙ্গীর। এঁদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের চিত্রকলার প্রথম প্রজন্ম, পঞ্চাশের দশকেই এঁরা স্নাতক হয়েছিলেন। এঁদের অধিকাংশই পরবর্তী এক দশকের মধ্যে উচ্চশিক্ষার্থে গিয়েছিলেন পশ্চিম মুলুকে। এই দলে ছিলেন এঁদের থেকে কিছুটা বয়োজ্যেষ্ঠ, কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে স্নাতক মোহাম্মদ কিবরিয়াও। রাজ্জাক আর বাসেত গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। কিবরিয়া জাপানে, আমিনুল-বশীর-রশিদ ইতালি-ফ্রান্সে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় পশ্চিমের দেশগুলো শিল্পের নতুন অর্থ সন্ধানে তখন ব্যাপৃত। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের প্রবল অভিঘাতে পশ্চিমা মানস ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত, অবক্ষয়ক্লিষ্ট আর সীমাহীন শূন্যতাবোধে অবসাদগ্রস্ত। বিশ শতকের শুরু থেকে আধুনিকতাবাদী নানা আন্দোলন পশ্চিমের শিল্পজগৎকে বিচিত্রভাবে বিকশিত করে তুলেছিল। উজ্জীবিত করেছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। পাল্টে গিয়েছিল পুরোনো সব খোলনলচে। অবয়বের ভাঙচুর ঘটছিল প্রচণ্ডভাবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চিত্রের জমিন থেকে অবয়ব পুরোদমে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা ইউরোপ–আমেরিকা–জাপানে গিয়ে শিল্পের এই নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে শিকাগোয় বাসেতও এই বিমূর্ত বাস্তবতায় অবগাহন করেছিলেন। সেখানে তাঁর দুই শিক্ষকের একজন ছিলেন মার্কিন, আরেকজন জার্মান।
পশ্চিমাফেরত শিল্পীদের বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারা ষাটের দশকে বাংলাদেশের চিত্রজগতে একটা নতুন আবেগ সঞ্চার করেছিল। কিবরিয়া ছিলেন এর নেতৃত্বে, বাসেত তাঁর নীরব সঙ্গী। দুজনের জীবনাচারের একটি মিল হলো, কেউই হইচই–কোলাহলের মধ্যে ছিলেন না। চিত্রের জমিনই ছিল তাঁদের চিন্তাভাবনা-ধ্যানধারণা প্রকাশের একমাত্র ক্ষেত্র; সভা-সমিতি, লেখালেখি, বক্তৃতা-বিবৃতি নয়। তবে এ কথাও ঠিক, ঢাকা আর বিক্রমপুরের সন্তান বাসেত উন্নত যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এলেও দেশজ মাটির গন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ণরূপে অরূপের সাধনায় নিমগ্ন হতে পারেননি।
প্রথম পর্বের জ্যামিতিকতা
১৯৫৬-৬২ কালপরিসর তাঁর শিল্পচর্চার সূচনা পর্ব। ওই কালে তিনি যেমন ঐতিহ্যলগ্ন ও প্রকৃতিমগ্ন, তেমনি কিউবিস্ট শিল্পীদের অনুপ্রেরণায় জ্যামিতিক ফর্মের আশ্রয়ে অবয়ব গঠনেও মনোযোগী। তেলরঙে আঁকা তাঁর ‘মাতৃগর্ব’, ‘বসন্ত’, ‘গোধূলি, ‘ধান ভানা’ এবং ‘মা ও মেয়ে’ চিত্রসকল এর বড় প্রমাণ। প্রকৃতির একান্ত পটভূমিতে গ্রামীণ নারীর কর্মমুখর জীবনের চঞ্চলতার মধ্যে তিনি শিল্পের সৌন্দর্য খুঁজে পান। সৌন্দর্য সন্ধান করেন নারীর মাতৃরূপে। পূর্বদেশীয় এসব মাটির গন্ধ তাঁর সৌন্দর্যের উৎস হলেও পশ্চিমদেশীয় আধুনিকতার সাহচর্যে একে পূর্ণ করে তোলেন। ইউরোকেন্দ্রিক আধুনিকতার আবহে তিনি অবয়বের যে ভাঙচুর করেন, তার মূলে কিউবিস্টদের সূক্ষ্ম প্রভাব অনুধাবন করা যায়।
ওপরের তালিকার প্রথম ছবিটি ১৯৫৬ সালে আর শেষটি ১৯৬০ সালে আঁকা। উভয় চিত্রে কিউবিক ফর্মে ভাঙচুরের চেষ্টা প্রশংসনীয়। বিশেষত, ‘মা ও মেয়ে’র চিত্রটি বাসেতের চিত্রভাবনা বা চিত্রশৈলী অনুধাবনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে আছে। একই ভঙ্গির ছবি তিনি পরবর্তীকালে বহুবার এঁকেছেন। এটি তাঁর পরিচয়জ্ঞাপক একটি অনিবার্য চিত্র। মায়ের ঊর্ধ্বমুখী মুখাবয়বের বিপরীতে মায়ের ভাঁজ করা হাঁটুতে মেয়ের নিম্নমুখী মুখাবয়ব স্থাপিত। দুটো অবয়বের উপবেশন ভঙ্গির মধ্যে অসাধারণ ভারসাম্য চিত্রটির বিরচন কৌশলকে (কম্পোজিশন) করে তুলেছে ব্যতিক্রমধর্মী। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের, এমনকি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে, জ্যামিতিক বিভাজন চিত্রটিকে সার্থক করে তুলেছে। এই চিত্রের পটভূমিতে রং ব্যবহারের মধ্যে ফর্ম সৃষ্টির যে প্রয়াস পরিলক্ষিত, তাতে আভাসিত হয় পরবর্তীকালের বিমূর্ত চিত্রের বৈশিষ্ট্য।
‘মা ও মেয়ে’র এই চিত্র প্রসঙ্গে স্মরণীয় জয়নুলের চিত্রে নারীর বিশিষ্ট উপবেশন ভঙ্গিটি। তবে দুজনের এ জাতীয় চিত্রের মধ্যকার পার্থক্যরেখাটিও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। জয়নুলের গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা ময়মনসিংহের, আর বাসেতের শৈশব কেটেছে বিক্রমপুরে। শুধু পটভূমির এই ভিন্নতাই নয়, দুজনের পর্যবেক্ষণের মধ্যেই ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ অমিল। শিল্পীমেজাজের ভিন্নতাও দুজনকে স্বতন্ত্র করেছে। জয়নুল, আনোয়ারুল, কামরুল—আমাদের এই তিন পথিকৃৎ শিল্পীই ছিলেন জলরঙে মাস্টার। বিশেষত ছাত্রদের ওপর জয়নুলের প্রভাব ছিল অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বাসেত এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, স্বতন্ত্র। জয়নুলের ঝোঁক ছিল তেলরঙের পরিবর্তে জলরঙের দিকে; বাসেত ছিলেন এর বিপরীত।
বিমূর্ততায় রঙের যত ফর্ম
মার্কিন মুলুকের শিক্ষা বাসেতের ছবির জমিনকে অবয়বমুক্ত করে। বিমূর্ততায় অবগাহনের মধ্য দিয়ে তিনি রঙের পটভূমি সৃষ্টিতেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর চিত্রের জমিন অতঃপর হয়ে ওঠে রঙের নানা আকার ও ওজনবিশিষ্ট ফর্মের বিরচন কৌশলের এক উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। কতভাবেই না তিনি রঙের লঘুভার সামঞ্জস্যচেতনা (মিনিমাইজেশন) সৃষ্টির মাধ্যমে চিত্রতলকে করে তোলেন প্রশান্তির আকর। সমতলীয় ভঙ্গির লেপনকৌশলের মধ্যেই তিনি বুনট (টেক্সচার) সৃষ্টির প্রয়াসে চিত্রভূমিকে করে তোলেন আকর্ষণীয় ও ব্যঞ্জনাময়।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিমূর্ত ধারার প্রধান শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার সঙ্গেই তাঁর তুলনা করা যায়। তবে কিবরিয়ার সঙ্গে একটা বড় পার্থক্য হলো, বাসেতের ছবি অধিকতর রঙিন। এর কারণ, জন্মভূমি থেকে উন্মূলিত কিবরিয়ার মনোবেদনা থেকে বাসেত ছিলেন মুক্ত। ১৯৮৩ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বাসেতের প্রথম প্রদর্শনীতে সব চিত্রই ছিল বিমূর্ত ধারার, যা দর্শকচোখে তাঁর রঙিন শিল্পান্বেষার এক বড় প্রমাণ।
রং নিজেই সৃষ্টি করছে নানা রূপের বা আকারের ফর্ম। তা শুধু আকৃতির বৈচিত্র্যকেই ব্যাপকতর করছে না, রঙের বিচিত্রতা দিয়ে কাছে-দূরের বোধ সৃষ্টি করছে, নির্ধারণ করছে ভার বা ওজন। এসব ফর্মের অনুভূমিক ও উল্লম্ব বৈশিষ্ট্যই নির্ণায়ক হয়ে উঠছে ভিন্নতর অর্থের দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনার। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বিরচন কৌশলের নৈপুণ্য। রঙের বিচিত্র রূপ, বিচিত্র ভার, তার বিরচণগত বিন্যাস, তার বুনট, তার লঘুভার সামঞ্জস্য—এই সবকিছু দর্শকচিত্তের আনন্দ ও প্রশান্তির কারণ হয়ে উঠছে। চিত্রতল অবয়বমুক্ত হয়ে নিরবয়বতার মধ্যে গিয়ে, রূপ থেকে অরূপের মধ্যে পৌঁছে সীমাকে অতিক্রম করে অসীমের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করছে। এমন চিত্রতল দর্শকের ভাবনাকে তার পরিচিত রূপজগতের মধ্যেই অনির্দিষ্টভাবে ভ্রমণ করিয়ে বেড়ায়। এখানেই শিল্পীর বিমূর্ত ধ্যানের সার্থকতা।
মূর্ত-বিমূর্তের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ
কিন্তু শিল্পী বাসেতের স্বাতন্ত্র্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অরূপের সাধনায় রত হয়েও তিনি রূপের সাধনাকে পরিহার করেননি। বরং সমান্তরালভাবেই এগিয়ে চলেছে তাঁর মূর্ত আর বিমূর্তের ধ্যান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ষাটের দশকের বিমূর্ত শিল্পের ধারাকে অনেকটা গতিহীন করে তুললেও বাসেতের চিত্রধারা তা থেকে মুক্ত। বহির্জগতের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ শিল্পী হিসেবে তাঁর ধ্যানকে বাধাগ্রস্ত বা প্রভাবিত করতে পারেনি। বাইরের ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও নিজ শিল্পভাবনায় থেকেছেন অচঞ্চল, স্থির। অর্থাৎ ষাট-সত্তর-আশির দশকে তাঁর একাগ্র চিত্তের শিল্পান্বেষায় অব্যাহত থেকেছে মূর্ত-বিমূর্তের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ।
তবে তাঁর রূপের অন্বেষা নব্বইয়ের দশকে প্যাস্টেল মাধ্যমে অর্জন করে এক নতুন গতিবেগ। মুখ্য হয়ে ওঠে নারী-রূপেরই ব্যাপক ধ্যান। এ পর্বের চিত্রে নারীর বিচিত্র রূপ ও ভঙ্গি তাঁর চিত্রতলকে মুখর ও সমৃদ্ধ করে তোলে। একালের চিত্রে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে অনেকগুলো সিরিজজাতীয় বিষয়। যেমন: ‘মা ও মেয়ে’, ‘মা ও শিশু’, ‘প্রতীক্ষারত নারী’, ‘পাখা হাতে নারী’, ‘ধান ভানা’, ‘জলকে চল’, ‘জেলে-জেলেনী’ প্রভৃতি। ভারতীয় পুরাণে সমুদ্রমন্থনের ফলে নারীর যে দুটো রূপের উত্থানের কথা বলা হয়েছে, তার একটি উর্বশীরূপ, আরেকটি লক্ষ্মীরূপ। শিল্পী বাসেত দ্বিতীয়টির ধ্যান করেছেন। তাঁর অন্বেষণের বিষয়: নারীর মাতৃরূপ, গৃহস্থ পরিবেশে নারীর কর্মমুখর সেবাপরায়ণ কল্যাণী রূপ। এ ক্ষেত্রে তিনি কামরুল হাসান থেকে পৃথক হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে এভাবেই কাজী আবদুল বাসেত বিশিষ্ট হয়ে আছেন। স্বভাবে একান্ত নিভৃতপরায়ণ ও প্রচারবিমুখ এই শিল্পী একাগ্রমনে শিল্পে নিমগ্ন থাকার মাধ্যমে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের জগতে একটি স্বতন্ত্র ও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন।
বিভিন্ন সংগ্রাহকের কাছ থেকে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে বেঙ্গল শিল্পালয় সম্প্রতি বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে মুক্ত করে একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীকে দর্শকসম্মুখে উপস্থাপন করেছে। মৃত্যুর দুই দশক পরে শিল্পী বাসেত তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে শিল্পানুরাগীদের কাছে আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। বেঙ্গল শিল্পালয়কে এ জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাই। ৮ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ২০২৫ সালের ১১ জানুয়ারি অব্দি।