গরু না গোরু?

>গরু না গোরু—কোন বানান ঠিক, এ নিয়ে তর্ক ছিলই। কিন্তু এবার কোরবানির ঠিক আগে আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ আবার সরব হয়েছেন অনেকেই। গরু বানান নিয়ে লিখেছেন তারিক মনজুর।

 গনি মিয়ার দুইটা গরু। একটা গরু মোটা, একটা গরু সরু। এত দিন চিন্তা ছিল সরু গরুটাকে নিয়ে। ওটা কবে মোটা হবে। এখন চিন্তা মোটা গরুটাকে নিয়েও। কোরবানির হাটে ঠিকমতো দাম উঠবে তো!

গনি মিয়ার মেয়ে গোপু। বাবার চিন্তা দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ‘বাবা, করোনার সময় হাটে যাওয়ার দরকার নাই।’

‘তাইলে গরু বেচুম ক্যামনে?’

খানিক ভেবে গোপু বলে, ‘ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলে হয় না?’

গনি মিয়া ফেসবুক বোঝেন। কিন্তু ফেসবুকে কী কী হয়, এগুলো বোঝেন না। তিনি বলেন, ‘পোস্ট দিলে কী হইব?’

মেয়ে বলে, ‘গরু দুইটার ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিব। যার পছন্দ কিনা নিবে।’

‘কিন্তু ফেসবুকে দাম পাওয়া যাবে?’

গোপুর বয়স মাত্র তেরো। সে দামের ব্যাপার-স্যাপার ভালো বোঝে না। বলে, ‘মোটা গরুটার দাম নিশ্চয় ভালো হবে।’

গনি মিয়া ভাবেন, ঈদের এখনো কিছুদিন বাকি আছে। তাই ফেসবুকে চেষ্টা করে দেখা যাক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েকে বলেন, ‘তাইলে ফেসবুকে গরু দুইটারে উডা!’

পরদিন সকাল। ঘুম থেকে উঠেই গোপু বাবার কাছে ছুটে আসে, ‘বাবা, গরু বানানে কি ও-কার আছে?’ এক রাতের মধ্যে অনেকেই তার পোস্ট দেখেছে। গরু কেনার লোক পাওয়া যায়নি একজনও। কিন্তু গরু বানান নিয়ে কথা বলার লোক পাওয়া গেছে অনেক।

গনি মিয়া দু-এক লাইন লিখতে পারেন। কিন্তু ওই লেখা পর্যন্তই। বানান নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। মেয়েকে বলেন, ‘ও-কার না দিলে কি গরুর দাম কইমা যাইব?’

মেয়ে বাবার কথার উত্তর দেয় না। সে ঘরে ঢুকে যায়। পড়ার বই খুলে গরু খুঁজতে থাকে। গরু খোঁজা এত কষ্ট! আগে কখনো মনে হয়নি তার কাছে।

দুই

গোপু গরু খুঁজতে থাকুক, ততক্ষণে আমরা বানানের খোঁজ নিয়ে আসি। বানানের সঙ্গে উচ্চারণের সম্পর্ক যেমন আছে; তেমনি আবার নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত উচ্চারণমূলক বানানের পক্ষপাতী ছিলেন। তাই ‘গোরু’ লিখতেন। পরে ই বা উ থাকলে অ-এর উচ্চারণ ও হয়ে যায়—এটা রবীন্দ্রনাথেরই আবিষ্কার। এই যুক্তিতে তিনি পরে ‘গরু’ লেখাতেও আপত্তি করেননি।

বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ আছে ‘নান্দের ঘরের গরু রাখোআল’। ধরা যাক, এটা ১৪৫০ সালের বানান। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর রচনাকাল নিয়ে তর্কের অবসান হয়নি। আর বড়ু চণ্ডীদাসের পুঁথি পুরোনো হতে পারে; তবে এর হস্তলিপি অনেক পরের। ফলে এই ‘গরু’ যে কোন সময়ের, তা বলা কঠিন। এর আগে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এ ‘গরু’ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায়: ‘উমত সবরো গরুআ রোষে’ (চর্যা: ২৮)। এটাকে কত সালের বানান বলবেন? ১২০০ সালের? ধরতে পারেন। তবে এই ‘গরু’ গুরু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। স্কুলজীবনে অনেকেই গুরুকে গরু বলেছেন। তাহলে, গরু আর গুরুকে আরও ভালো করে আলাদা করার জন্য ‘গোরু’ আর ‘গুরু’ লিখলে কি ভালো হতো?

বানান আসলে এত কিছু মানে না। বানান দীর্ঘদিনের প্রথার ব্যাপার। সেই প্রথাকে আকস্মিকভাবে বদলে দিলে তাৎক্ষণিকভাবে আড়ষ্ট হতে হবে আপনাকে। মজার ব্যাপার, ভাষা এই আকস্মিক পরিবর্তনকেও আত্তীভূত করে নিতে পারে। যে কারণে মধ্যযুগের হস্তলিখিত পুঁথিতে যেন, যদি, যখন ইত্যাদি বানানে বর্গীয়-জ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম পর্বে (১৮০১) অন্তস্থ-য দ্বারা প্রতিস্থাপনে বাংলা ভাষার গুরুতর সমস্যা হয়নি। এমনকি আবেগের কথা পাশে রেখে ভাবুন, অন্য ভাষার হরফ দিয়ে লিখলে কী এমন সমস্যা হয়? মোবাইল বা বিভিন্ন মাধ্যমে তো পৃথিবীব্যাপী মানুষ এভাবে চালাচ্ছে। যেসব ভাষার নিজস্ব হরফ নেই, সেগুলোও তো প্রয়োজনে অন্য ভাষার হরফ দিয়ে চলছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বানান কি শব্দের ব্যুৎপত্তিকে মান্য করে? করতে পারে। উনিশ শতকের শুরুতে কান, সোনা এসব শব্দ লেখা হতো মূর্ধন্য-ণ দিয়ে। যুক্তি ছিল, মূলশব্দ কর্ণ, স্বর্ণ বানানে মূর্ধন্য-ণ আছে। আবার কষ্ট, কাষ্ঠ ইত্যাদির অনুসরণে লেখা হয়েছে ষ্টার, ষ্টেশন। তাতে সমস্যা কোথায় ছিল? বিশ শতকে এসে বলা হলো, আমাদের উচ্চারণে মূর্ধন্য-ণ নেই, মূর্ধন্য-ষ নেই। ‘বিদেশি’ বলে বদলে দেওয়া হলো বাংলা শব্দের বানান। আপনি কি বলতে পারেন, কোন কোন শব্দ বিদেশি? লন্ঠন, ভান্ডার সজ্ঞানে প্রায় সবাই লিখতেন মূর্ধন্য-ণ দিয়ে। এত দিন পরে অনেকে জানলেন, লন্ঠন, ভান্ডার এসব শব্দ মূর্ধন্য-ণ দিয়ে লেখা যাবে না। কারণ, এগুলো বিদেশি শব্দ, কিংবা অতৎসম শব্দ। কী অদ্ভুত! বাংলা শব্দকে তৎসম-অতৎসম ভাগ করে এবং বাংলা ধ্বনি পদ্ধতিকে অগ্রাহ্য করে প্রায় অবৈজ্ঞানিক নিয়ম চাপিয়ে দিলেন পণ্ডিতেরা। আর সঙ্গে সঙ্গে বানানের ভুল-শুদ্ধ ধরতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন ভাষা ব্যবহারকারীদের অনেকে। কারও কারও বানানবিষয়ক তর্ক দেখে মনে হয়, বানানের চেয়ে বর্ণের ওপরে ক্ষোভ বেশি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বর্ণ সংযোগের প্রয়োজন অনুভব করেছেন, অনেকে তখন বর্ণ ঝেড়ে ফেলার জন্য অতি উদ্যোগী!

কেউ কেউ বলতে পারেন, ব্যুৎপত্তি মূলশব্দ ‘গো’ ধরলেও তো গরু বানান ‘গোরু’ হয়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ১৬০০ সালের পুঁথিতে পাওয়া যাচ্ছে, ‘ধান্য গোরু কেহ নাঞি কেনে’। ১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বানানে ‘গোরু’ আছে। কাজী নজরুল ইসলাম ‘গোরু’ লিখেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌, অন্নদাশঙ্কর রায় এঁরা ‘গোরু’কে মেনেছেন। তাঁরা ব্যুৎপত্তি কিংবা উচ্চারণকে বানানের আদর্শ ধরে প্রয়োগ করেছেন, এটা বলা যাবে না। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, বানান আসলে প্রথার ব্যাপার। প্রথাভঙ্গ হলেই চোখে লাগে। অনেকের গায়ে লাগে। ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও বেশি সাহস দেখাতে পারেনি। তাদের চেষ্টা ছিল, একটা শব্দের অনেকগুলো বানান থাকলে সেগুলোকে কমিয়ে একটিতে আনা যায় কি না। এখন পর্যন্ত বানান নিয়ে সেটাই সবচেয়ে বড় ও কার্যকর উদ্যোগ। কিন্তু তর্ক-বিতর্ক সেখানেও কম হয়নি। আর ১৯৭৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কারে আরেকবার উদ্যোগ নিয়ে তো পিছিয়েই এল।