এত দিন গল্পের যে নিরীক্ষা করে এসেছি, এ বইয়ে তার সম্প্রসারণ দেখা যাবে

>প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের সৃজনশীল শাখায় এবার পুরস্কৃত হয়েছে শাহাদুজ্জামানের গল্পগ্রন্থ মামলার সাক্ষী ময়না পাখি। এই বই লেখার আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন লেখক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
শাহাদুজ্জামান। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শাহাদুজ্জামান। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

আলতাফ শাহনেওয়াজ: ১৪২৫ বঙ্গাব্দে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’–এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কৃত হয়েছে আপনার গল্পগ্রন্থ মামলার সাক্ষী ময়না পাখি। আপনার অনান্য গল্পের বইয়ের চেয়ে এই গ্রন্থের বিশেষত্ব কী বলে মনে করেন?


শাহাদুজ্জামান:
এত দিন গল্পের বিষয় ও আঙ্গিকের যে নিরীক্ষা আমি করে এসেছি, এই বইয়ে তার একটা সম্প্রসারণ হয়তো দেখা যাবে। এ বইয়ে আঙ্গিকের নিরীক্ষাগুলো আমি করেছি তুলনামূলকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে। বইয়ের ‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন’ গল্পটি আসলে একাধারে গল্প ও গল্পের সমালোচনা। আমি একটা প্রবন্ধকেই গল্পে রূপান্তরিত করেছি বলা যেতে পারে। কিংবা ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ নামের প্লটবিহীন গল্পে কথার ছলে বিবিধ জটিল দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। আবার আঁটসাঁট প্লটনির্ভর গল্প ‘টুকরো রোদের মতো খাম’ লিখেছি এক বসায়, যা আমার আগের গল্প লেখার ক্ষেত্রে বিশেষ ঘটেনি। এ ছাড়া এ বইয়ে আমি এমন কিছু বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছি, যা আমার আগের কোনো গল্পে আসেনি। ফলে বলতে পারি, এত দিনের গল্প লেখার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ গল্পগুলো অনেকটাই নির্ভার হয়ে লিখেছি, যার ছাপ হয়তো মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বইটিতে পাওয়া যাবে।

আলতাফ: মামলার সাক্ষী ময়না পাখিতে আমরা দেখতে পাই আপনার নতুন এক বিন্যাস—এখানকার বেশ কয়েকটি গল্পেই রয়েছে নিটোল প্লট। তবে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্রথম বই কয়েকটি বিহ্বল গল্প থেকে পরবর্তী গল্পবইগুলোতে আপনার যে ধারাটি প্রধান হয়ে ওঠে, সেটি অতটা প্লটনির্ভর গল্প নয়, যতটা তা ভাবনা বা ধারণানির্ভর গল্প। এখানে এই যে আপনার প্লটের দিকে যাত্রা, সেটি কেন?

শাহাদুজ্জামান: বলছিলাম যে এই বইয়ে আমি বেশ কিছু নতুন বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে আমাদের জীবনের বাঁকবদলের ভেতর আকস্মিকতার একটা বড় ভূমিকা আছে। একটা জীবন কীভাবে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তার ভেতর একটা ঘোর অনিশ্চয়তা থাকে। জীবনের খুব গভীরে একটা নির্মম কৌতুকও যেন আছে। আমরা অবিরাম স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙবার জন্য কোথাও কিছু একটা ওত পেতে থাকে। আমি কেবল আশার বেসাতি না করে জীবনের সেই আকস্মিকতার, অসহায়ত্বের জায়গাগুলোও বিষয় হিসেবে ধরতে চেয়েছি গল্পে—এবারের বেশ কয়েকটা গল্পে। একটা নিটোল গল্পের ভেতর দিয়ে এই থিমগুলোকে বরং অনেক বেশি স্পষ্ট করে তোলা যায়। সে কারণেই সম্ভবত এই বইয়ে বেশ কিছু প্লটনির্ভর গল্প লেখা হয়েছে।

আলতাফ: লেখালেখির শুরু থেকেই মূলত নাজুক মানুষের গল্প বলতে চান আপনি, এমন সব মানুষ, সাধারণের ভেতরে থেকেও যারা থাকে আমাদের চোখের বাইরে। মামলার সাক্ষী ময়না পাখিতে তো একটা গল্পই আছে ‘নাজুক মানুষের সংলাপ নামে’। তো, নাজুক মানুষের প্রতি আপনার এই পক্ষপাতের কারণ কী?

শাহাদুজ্জামান: আমি মনে করি, আমরা যে সময়কালের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করছি, তাতে ব্যক্তিমানুষ নানা জটিল চাপের ভেতর থাকে। যে ভৌগোলিক অবস্থানেই থাকি না কেন, বিশ্বায়নের কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ঘটনা–দুর্ঘটনার অভিঘাত আমাদের জীবনে এসে পড়ে। সিরিয়ার যুদ্ধ, অস্ট্রেলিয়ার দাবানল, আমেরিকার ড্রোন হামলা আমারই অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে ওঠে। এই বৈশ্বিক উদ্বিগ্নতার সঙ্গে যুক্ত হয় নানা স্থানিক উদ্বিগ্নতা। আমাদের দেশের রাজনীতির, ইতিহাসের নানা বাঁকবদল হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয় ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে আমাদের জালের মতো ঘিরে রেখেছে বাজারি অর্থনীতি। বাজারের নিয়ম অনুসারে সবাই সবার প্রতিযোগী। এতে করে মানবিক সম্পর্কের জায়গাগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। নানা রকম অদৃশ্য বর্ম পরে মানুষের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এই আশংকায় যে আমাদের আবেগ, বিশ্বাসের জায়গাগুলোতে আঘাত আসতে পারে নিকট, দূর—যেকোনো মানুষের কাছ থেকে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ব্যক্তিমানুষ খুব নাজুক থাকে বলেই মনে করি। মানুষের খুব গভীরে তো ভালোবাসা, আস্থা, স্বস্থির তৃষ্ণা থাকে। আপাতসফল, ব্যস্ত, সুখী মানুষটার আড়ালে যে নাজুক মানুষটা আছে, লেখক হিসেবে আমি তার দিকে নজর দেওয়া জরুরি মনে করি।