‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’
'মামলার সাক্ষী ময়না পাখি'র জন্য শাহাদুজ্জামান ও 'বাংলার দর্শন: প্রাক্-উপনিবেশ পর্ব'র জন্য রায়হান রাইন পুরস্কৃত
ভিড় আর শীতের কাছে পরাজিত না হয়ে যাঁরা হাজির হয়েছিলেন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে, তাঁদের জন্য গতকাল রোববারের সন্ধ্যাটা ছিল উপভোগের। বই পুরস্কার নিয়ে একটি ছিমছাম অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে রইলেন তাঁরা।
সঞ্চালক সাজ্জাদ শরিফ যখন তাঁর সূচনা বক্তব্য দিতে মঞ্চে এলেন, তখনো মঞ্চে কেউ নেই, সুন্দর করে সাজানো কিছু বই আর সামনে কয়েকটি চেয়ার ছাড়া। প্রথম আলোর এই ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জানালেন বর্ষসেরা বই পুরস্কারের ইতিবৃত্ত। জানালেন, এ বছর ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে সৃজনশীল শাখায় শাহাদুজ্জামানের গল্পের বই ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ এবং মননশীল শাখায় রায়হান রাইনের গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলার দর্শন: প্রাক্-উপনিবেশ পর্ব’।
দুটি আবৃত্তি দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন শারমীন মুস্তাফা। তাহসিন রেজা আবৃত্তি করেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর কাজী সব্যসাচীর কল্যাণে এই আবৃত্তি দুটি বহু আগেই শ্রোতার মন ছুঁয়েছিল। অনেকেই ভাসলেন সেই নস্টালজিয়ায়।
এরপর সঞ্চালকের আহ্বানে পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই লেখকসহ বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, ভীষ্মদেব চৌধুরী ও সুমন রহমান মঞ্চে এলেন। পারিবারিক কারণে শাহীন আখতার উপস্থিত হতে পারেননি।
বিচারকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমার জন্য আনন্দের একাধিক কারণ আছে। একটি কারণ বিচারক হওয়ার সুবাদে অনেকগুলো বই পড়ার সুযোগ হয়েছে। দ্বিতীয় আনন্দ, এই দুজন লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতা আছে।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে প্রযুক্তির উদ্ভাবন সাহিত্যকে বিপদগ্রস্ত করেনি। কিন্তু একালে যখন মোবাইল ও ইন্টারনেট এসেছে, এগুলো সাহিত্যকে কোণঠাসা করতে চাচ্ছে। এর কারণ কিন্তু ওই আবিষ্কারগুলো নয়, বরং সেসবের ব্যবহার। এখন মানুষের স্থূল ভোগলিপ্সা উৎসাহিত হচ্ছে। মুনাফাই নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। এই কোণঠাসা অবস্থাতেই আজ সাহিত্যের চর্চা খুব বেশি জরুরি।’
সঞ্চালক এরপর রসিকতা করে বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মঞ্চটি খুব ভারী। যাঁরা পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং বিচারকমণ্ডলীর সবাই অধ্যাপক।’
এরপর শাহাদুজ্জামানের অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য কবি সুমন রহমান। লেখককে উত্তরীয় পরিয়ে দেন রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। ক্রেস্ট ও এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
শাহাদুজ্জামান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘অক্ষর দিয়ে আমি এক জীবনে অনেকগুলো জীবনযাপনের সুযোগ করে নিয়েছি। কিন্তু এটাও টের পাই, বিশ্বায়নের এই সময়ে বিস্তৃত জীবনকে স্পর্শ করার যে অভিযাত্রা, তা খুবই দুরূহ, জটিল ও বেদনার। বিশ্বায়নের চাপের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে স্থানিকতার চাপ। আমাদের এ দেশের ইতিহাস, রাজনীতির বাঁকবদল হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে, পাড় ভাঙছে আর সেটার সূত্র ধরে আমাদের অভিজ্ঞতা, চেতনারও পাড়গুলো ভাঙছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক ও স্থানিক অভিজ্ঞতার চাপে পড়ে ব্যক্তিমানুষ ভীষণ নাজুক অবস্থায় পড়ে যান।’
এরপর রায়হান রাইনের অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। এই লেখককেও উত্তরীয় পরিয়ে দেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ; ক্রেস্ট ও এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
রায়হান রাইন তাঁর প্রতিক্রিয়ার শুরুতেই প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘দ্বিতীয়বারের মতো পুরস্কার পেলাম। বাংলা অঞ্চলের দর্শন নিয়ে এই কাজটি একটা দীর্ঘ পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে। প্রাচ্যে যে দর্শনের একটা ঐতিহ্য আছে, প্রতিটি সংস্কৃতির মধ্যেই দর্শনের একটা জায়গা আছে, এই ব্যাপারটা প্রথম দিককার ইতিহাসকারেরা, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দর্শন যাঁরা লিখেছেন তাঁরা অগ্রাহ্য করেছেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যাঁরা দর্শনের ইতিহাস লিখেছেন, এঁরা ব্যাখ্যা করছেন ইউরোপের বাইরে দর্শন নেই। কেন তাঁরা এটাকে বাদ দিচ্ছেন, সেই ব্যাখ্যা পড়লে বোঝা যায় এর মধ্যে ভীষণ একটা বর্ণবাদ আছে, অজ্ঞতাও আছে। এসব কারণে আমাদের সিলেবাসে ইউরোপীয় দর্শনের বাইরে ভারতীয় দর্শনের একটা অংশ খুবই ছোট করে দেওয়া আছে। বাংলার দর্শনও উপেক্ষিত হয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই আমার অনুসন্ধান।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বক্তব্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। প্রথম আলো সম্পাদক জানান, এই ১৬ বছরে সৃজনশীল ও মননশীল শাখায় পুরস্কারপ্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের নাম। তিনি বলেন, ‘কতগুলো বই পাঠকপ্রিয় হয়? প্রশ্নটা প্রায়ই দেখা দেয়। যখন বিচারকমণ্ডলী কোনো কোনো বছর এমনও হয়েছে, সত্যিকার অর্থে পুরস্কার দেওয়ার মতো বই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। কেন এমন হয়, এর জবাব আমরা খুঁজে পাই না। আমরা, আমাদের আগের বা পরের প্রজন্ম, আমরা বই ভালোবাসি, বই পছন্দ করি, আমরা বই সংগ্রহ করি। বই দেখলেই আমাদের ভালো লাগে। আমরা জানি, সংবাদপত্রের পাঠক কিছু কমছে। তাঁরা কি বই পড়ছেন? এ প্রশ্নের জবাবও আমাদের কাছে নেই। তবে এটা জানি, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে বই প্রকাশ হচ্ছে বেশি এবং বই বিক্রি হচ্ছে বেশি। প্রথমার কথা বললে বলব, বিপুল পরিমাণে প্রথমার বই বিক্রি হচ্ছে। বইয়ের মৃত্যু নেই। ছাপা বইয়ের মৃত্যু হবে না, যতই ইন্টারনেট, ডিজিটাল আসুক না কেন, এটা আমাদের বিশ্বাস।’
সান্ধ্য আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। তবে অনুষ্ঠান শেষেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত অনুষ্ঠানস্থলে চলতে থাকে সাহিত্যিক ও সাহিত্যানুরাগীদের গুঞ্জরন।