দিল্লিতে কবিতা উৎসব
একই আসরে কবিতা পড়তে এসেছেন ইসরায়েলের কবি আমির ওর এবং ফিলিস্তিনের কবি নাজওয়ান দারবিশ, মাঝখানে নীরবে বয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের দীর্ঘ তিক্ত ইতিহাস, আলোচনার বিষয়বস্তু ‘কবিতায় স্বাধীনতা ও মতবিরোধ’।
নাজওয়ান দারবিশ জেরুজালেমে জন্মেছেন ১৯৭৮ সালে, কবিতা লেখেন আরবি ভাষায়। দিল্লিতে রাজা ফাউন্ডেশন আয়োজিত এশিয়ান কবিতা উৎসবে বেশ রাগী ভঙ্গিতে, ইংরেজি ভাষায় বললেন, ‘আমরা যখন কবিতার স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলব, তখন সত্য বলার এবং রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও কথা বলা উচিত, কারণ, এরা তো হাত ধরাধরি করেই চলে। নয়তো কবিতা নিয়ে আসলে বলার কিছু নেই, কারণ, কবিতা নিজেই নিজের কথা বলে। বাস্তব জীবনে সত্য বলার স্বাধীনতা না থাকলে কবিতায় আর কি স্বাধীনতার কথা বলতে পারি আমরা? স্বাধীনতা ও কবিতার অর্থ আমার কাছে কীই–বা হতে পারে, যখন এই মঞ্চে আমি আমার কথা বলছি আর আমার উপনিবেশ স্থাপনকারী এখানেই বসে আছেন। আপনারা সবাই জানেন আমি কার কথা বলছি...।’
দারবিশের বক্তব্যের সূত্র ধরে স্বাভাবিকভাবেই সবার চোখ নিজের অজান্তেই খুঁজতে থাকল আমিরকে, তেল আবিবে বসবাসকারী ৬৩ বছর বয়সী আমির ওর, ইসরায়েলের খুব জনপ্রিয় কবি ও অনুবাদক, যিনি খানিক আগেই হল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন।
‘...নানা নামে নতুনভাবে চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক আর সামাজিক উপনিবেশের এই অন্ধকার সময়ে কবি হওয়াটাই খুব কঠিন ব্যাপার।’ দারবিশ তাঁর আলোচনার উপসংহার টেনে বললেন। রাতে ডিনারের সময় এক ফাঁকে নাজওয়ানকে বললাম, ওদের দেশের কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা বাংলায় অনুবাদ হওয়ার কথা।
‘ওহ্, নামে মিল থাকলেও তাঁর সঙ্গে আমার কিন্তু কোনো সম্পর্ক নেই।’ নাজওয়ান বললেন, ‘কবিতার বঙ্গানুবাদ হওয়ার তথ্যটা জানলে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হতেন, কিন্তু এখন তো আর সেটা জানানোর উপায় নেই, কারণ, ১০ বছর আগেই তিনি ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেছেন।’
পরদিন আমিরের আলোচনার বিষয় ছিল ‘সত্য-উত্তর সময়ে কবিতার সত্য’। সেখানে তিনি বেশ দৃঢ় কণ্ঠেই বললেন, ‘কবিতা কোনো তথ্য জানায় না, ঘটনাও জানায় না; কিন্তু কবিতা সত্য বলে, স্বাধীনতার কথা বলে। কবিতা একধরনের প্রজ্ঞা এবং এটি কিছুই বাদ দেয় না—অনুভূতি, চিত্রকল্প, স্মৃতি বা দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতা কাঠামোর জন্য কবিতা একটা হুমকি, ক্যাথলিক চার্চ থেকে শুরু করে সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্যন্ত এবং প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র থেকে আধুনিক শাসকের সামনে পর্যন্ত কবিতা বিপজ্জনক। কবিতা আমাদের আমন্ত্রণ জানায় ভাবতে এবং নিজেকে অনুভব করতে।’
তিন দিনের এই আয়োজনে আরও অংশ নিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবীণ কবি কো উন, ভিয়েতনামের নির্বাসিত কবি নগুয়েন হোয়াং বো ভিট, আর্মেনিয়ার দুই কবি মারিন পেট্রোসিয়ান ও হাসমিক সিমোনিয়ান, জাপানি কবি ইমিকো মায়াসিতা, ভুটানের চাদর ওয়াংমো, চীনের ইয়াং লিয়ান, সিঙ্গাপুরের আলভিন পাং এবং ভারতের মালায়লাম, তামিল, বাংলা ও হিন্দি ভাষার কবিরা।
ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে কবিকণ্ঠে তাঁর নিজের ভাষায় এবং সেই সঙ্গে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা কবিতার ইংরেজি ও হিন্দি অনুবাদ পড়া হচ্ছিল। কবিতা পাঠের ফাঁকে ফাঁকে ছিল সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আমার আলোচনার বিষয় ছিল, ‘কবিতা ও সন্ত্রাস’। আমি খুব সহজভাবেই বলেছি, কবিতা যদি হয় আত্মার ভাষা, তবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা সেই আত্মাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান বিপুল বিনাশী বিস্তৃত সন্ত্রাসের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা হয়তো ‘অত্যাচারিতের কণ্ঠস্বর’ হতে পারে, কিন্তু সন্ত্রাস থামাতে পারে না। কাকতালীয়ভাবে এই উৎসবের আগের দিনই জম্মু–কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় সন্ত্রাসী হামলায় ৪০ জন মারা গিয়েছিল আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সে জন্য এক মিনিট নীরবতাও পালন করা হয়েছিল।
এ বছর ১৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে হয়ে যাওয়া এই কবিতা উৎসবের পেছনের কথা বলতে গেলে ভারতের অন্যতম আধুনিক চিত্রশিল্পী সৈয়দ হায়দার রাজা বা এস এইচ রাজার নাম বলতেই হবে। আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার সবচেয়ে দামি শিল্পী বলা হয় তাঁকে। ২০১১ সালে তাঁর ছবি ‘সৌরাষ্ট্র’ বিক্রি হয়েছিল ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায় আর ২০১৪ সালে তাঁর একটি ছবির দাম উঠেছিল ১৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ—তিনটি সম্মানই অর্জন করেছিলেন তিনি। প্রখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের সমসাময়িক এই শিল্পী জন্মেছিলেন ভারতের মধ্যপ্রদেশে, ১৯২২ সালে। চিত্রকলাচর্চার টানে পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেও চিত্রকলায় নিজস্ব রং, ভাষা ও চিন্তা নির্মাণের কারণে দেশ–বিদেশে প্রশংসিত হন তিনি। বিশেষ করে পাশ্চাত্য বাস্তববাদের প্রভাব এড়িয়ে ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের নতুন রূপায়ণের জন্য তাঁর কাজ প্রসিদ্ধ।
২০১৬ সালে ভারতের দিল্লিতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ফরাসি সরকারের ‘লিজিয়ন অব অনার’–এ ভূষিত এই শিল্পী। রাজা ফাউন্ডেশন তাঁরই গড়া শিল্প ও সংস্কৃতি সংস্থা, যারা প্রতিবছরই শিল্প–সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে। এ ছাড়া তরুণ চিত্রশিল্পীদের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা, ফেলোশিপ দেওয়া, সংগীতায়োজন, বিভিন্ন রকমের প্রকাশনাসহ আরও নানা কাজে ব্যস্ত এই ফাউন্ডেশন।
রাজা ফাউন্ডেশনের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনার পেছনের মূল মানুষটি হচ্ছেন অশোক বাজপেয়ি—কবি, সংগঠক ও সাবেক আমলা। সৈয়দ হায়দার রাজার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষটি কথায় কথায় বলেছেন, ‘রাজা সাহেব তাঁর খ্যাতি ও গৌরব সৃজনশীল মানুষদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইতেন। আমরা তাঁর সেই চাওয়াকেই সম্মানিত করছি। এই কবিতা উৎসবের নাম “বাক”, যা একটি সংস্কৃত শব্দ, এর অর্থ কথা বলা। আবার বাক একজন দেবীও বটে, যিনি কবি, দার্শনিক ও শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জোগান। ২০১৯ সালের দ্য রাজা বিয়েনালে অব এশিয়ান পোয়েট্রির শিরোনাম তাই বাক।’
উৎসবে যে ২৪ জন কবি অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের সবার ১০টি কবিতার ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে রাজা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে।