বাংলার মুদ্রণশিল্পের খণ্ডচিত্র
শিক্ষিত, রুচিশীল ও মননশীল সমাজ গড়ার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে বই। একটি দেশের চিন্তাচেতনা ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ওই দেশের বই, সংবাদপত্র ও সাহিত্যপত্রের মাধ্যমে। দীর্ঘকাল ধরে সংবাদপত্র ও সাহিত্য আমাদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প। মুদ্রণ ও প্রকাশনা আলাদা দুটি মাধ্যম হলেও একটি অন্যটির পরিপূরক। এখন আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের এমন কোনো অনুষঙ্গ পাওয়া যাবে না, যেখানে মুদ্রণের ব্যবহার নেই। আর পুস্তক প্রকাশনায় যে মুদ্রণের অন্যতম ভূমিকা রয়েছে, তা তো বলাই বাহুল্য। এ লেখায় মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসের রেখাচিত্র আঁকার পাশাপাশি বাংলার মুদ্রণশিল্পের খণ্ডচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে।
প্রথমেই বলে রাখি, এই ব্রহ্মাণ্ডে মুদ্রণশিল্পের সূচনা হয়েছিল বই মুদ্রণের মধ্য দিয়ে। ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে চীনে প্রাপ্ত হীরক সূত্রই বিশ্বের প্রাচীনতম মুদ্রিত গ্রন্থ।
১৫ শতকে ছাপাখানার জনক জোহানেস গুটেনবার্গ (১৪০০—১৪৬৮) তাঁর আবিষ্কৃত মুদ্রণযন্ত্রের জন্য ধাতব টাইপ উদ্ভাবন করেন। তাঁর এই চলমান হরফ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রণীত হয় সংবাদপত্রের বর্ণমালা তৈরির যান্ত্রিক প্রযুক্তি। সীসার হটমেটালের গুটেনবার্গীয় প্রযুক্তি একসময় রূপ নেয় ফাউন্ড্রি বা টাইপকাস্টিং মেশিনে। তবে মুদ্রণযন্ত্রের ক্রমবিকাশের ধারায় গুটেনবার্গের পর যাঁর নাম সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি জার্মানের ফ্রেডরিক কোয়েনিগ। তিনিই মুদ্রণযন্ত্রে প্রথম সত্যিকারের পরিবর্তন করেন। বর্তমান বিশ্বে প্রধানত পাঁচ ধরনের মুদ্রণপদ্ধতি দেখা যায়। এগুলো হলো লেটারপ্রেস মুদ্রণ, লিথো অফসেট মুদ্রণ, গ্রাভিউর মুদ্রণ, স্ক্রিন মুদ্রণ ও খোদাই মুদ্রণ।
ভারতীয় উপমহাদেশের গোয়াতে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র তথা ছাপাখানার প্রবর্তক পর্তুগিজরা, ১৫৫৬ সালে। আর তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রণের যাত্রা সম্পর্কে বলার আগে ১৭৭৮ সালের কথা অবশ্যই বলতে হবে। কারণ, বাংলার মুদ্রণজগতে এ সন বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ বছরই প্রকাশিত হয় ন্যাথালিয়ান ব্রাসে হ্যালহেড রচিত আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। বাংলা প্রদেশ থেকে বাংলা অক্ষরে (ইংরেজি অক্ষরেও) ছাপা প্রথম বই এটি, যা খোদাই করেছিলেন চার্লস উইলকিন্স।
এর কিছুদিন পরই ১৭৭৯ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ছাপাখানা। যদিও সালটি নিয়ে মতবিরোধ আছে, তবে এটা ঠিক, এর পরের বছর ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি বাংলার প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট ছেপে প্রকাশ করেন। অনেকের মতে, এটিই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ছাপাখানা।
সেই সময়ের পূর্ববঙ্গে মূলত মুদ্রণের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৪৭ সালে, রংপুরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে। পরে ১৮৪৮ সালে ঢাকায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়।
তবে পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয় ১৮৬০ সালে, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসে পাওয়া যায়, এখানে একসময় কাঠের তৈরি মুদ্রণযন্ত্রও ব্যবহার করা হয়েছে। যশোরে ১৮৬৮ সালে ‘অমৃত প্রবাহিণী যন্ত্র’ নামে একটি কাঠের মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ। বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে সম্পাদক হিসেবে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন তিনি।
কিন্তু বাংলাদেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনার প্রসার নিয়ে বলতে গেলে যে নামটি না নিলে এর ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না, তিনি তৎকালীন নদীয়ার (বর্তমানে কুষ্টিয়া) কুমারখালী মহকুমার কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। অত্যাচারিত কৃষকদের অধিকার আদায়ে একসময় তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে লিখতেন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। পরে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে (বাংলা ১২৭০) কলকাতার গিরিশ চন্দ্র বিদ্যারত্ন মুদ্রণযন্ত্র থেকে প্রকাশিত হলো মাসিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। এরপর কাঙাল হরিনাথ ১৮৭৩ সালে মথুরনাথ মৈত্রের সহযোগিতায় কুমারখালীতে কাঙাল হরিনাথ মথুরনাথ যন্ত্র স্থাপন করেন। এটি এমএন প্রেস নামে বিখ্যাত হয়।
কাঙাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের মৃত্যুর পর এখন তাঁর স্ত্রী গীতা মজুমদার পরিচালনা করছেন এই প্রেস। গীতা মজুমদারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক সূত্রে কাঙাল হরিনাথের পর প্রেসের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর সন্তান বাণীশ মজুমদার। পরবর্তী সময়ে বাণীশ মজুমদারের সন্তান অতুলকৃষ্ণ মজুমদার দায়িত্ব নেন। তারও পরে অতুলকৃষ্ণের সন্তান অশোক মজুমদার প্রেসটি চালিয়েছেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত। আর মথুরনাথ যন্ত্র সর্বশেষ ব্যবহৃত হয়েছে ১৯৮৪ সালে, ভোটার তালিকা ছাপানোর কাজে।
কুমারখালী স্টেশন বাজারে কাঙাল হরিনাথের প্রেসের নাম অনুসারে এমএন প্রেস নামে প্রেসটি এখনো আছে, যদিও তার অবস্থা টিমটিমে।
সময়ের বিবর্তনে গোটা মুদ্রণব্যবস্থা ও কম্পোজিং পদ্ধতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। একসময় ছিল শুধু হ্যান্ড কম্পোজিং পদ্ধতি। পর্যায়ক্রমে এসেছে মনোটাইপ, লাইনোটাপ, ফটোটাইপ সেটিং এবং সর্বশেষ কম্পিউটার কম্পোজ, যা ডিটিপি বা ডেস্কটপ পাবলিশিং নামে পরিচিত। এ ছাড়া পেজ মেকআপ, বিভিন্ন ধরনের টাইপ ফেসসহ অলংকরণ, প্রচ্ছদ—সব ক্ষেত্রেই এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শ।
এ ধারায় পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। বাংলা প্রকাশনা বলতে আমরা বুঝি ২০০ বছরের অধিক বয়সী বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার ধারাবাহিকতা। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশের প্রকাশনা বলতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনার গতি–প্রকৃতি ও অবস্থান বোঝা হয়’—মফিদুল হকের এই উক্তি মনে রেখে এটা বলতেই হবে যে আমাদের এখানকার মুদ্রণ ও প্রকাশনায়ও লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। ‘মুদ্রণ প্রযুক্তি ও গ্রন্থ প্রকাশনা’ শিরোনামের নিবন্ধে ২০০৮ সালে মির্জা তারেকুল কাদের হিসাব দিয়েছেন, সংবাদপত্র, পুস্তক প্রকাশনা ও অন্যান্য ক্ষেত্র মিলিয়ে বাংলাদেশে মুদ্রাকরের সংখ্যা ১ হাজার ২০০, এর মধ্যে উন্নতমানের সংখ্যা ৫০০–এর মতো, যদিও বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই মনে হয়।
বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে আমাকে। ফলে এ দেশের মুদ্রণব্যবস্থার কয়েকটি আমার নজরে এসেছে। প্রথমত, দেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনা খাতের প্রযুক্তিগত বিকাশ হয়েছে সেকাল আর আধুনিকতার মিশ্রণে। দেশের বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরোনো প্রযুক্তি বাদ দিয়ে নতুন প্রযুক্তি কেউ ব্যবহার করছেন না। হয়তো আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার করছেন, কিন্তু কাটিং, বাইন্ডিং পুরোনো প্রযুক্তির; আবার কোনো প্রতিষ্ঠান মুদ্রণযন্ত্র, কাটিং, বাইন্ডিং—সব ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও একই সঙ্গে পুরোনো মুদ্রণযন্ত্রও চালু রেখেছেন।
দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাইডেলবার্গ মুদ্রণযন্ত্র। এরপর রয়েছে রোল্যান্ড কোম্পানির মেশিন। দুটিই জার্মানির মুদ্রণযন্ত্র। তারপর রয়েছে সোলনা ও হাশি মোটো। আর পত্রিকার প্রেসগুলোতে ওয়েব অফসেটের মধ্যে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ওরিয়েন্ট কোম্পানির মেশিন। এটি অ্যানালগ। এর পরে রয়েছে মনোগ্রাফ। মনোগ্রাফ আধুনিক মেশিন।
তৃতীয়ত, বর্তমানে বাংলাদেশে মুদ্রণ ও প্রকাশনার যে চিত্র, তাতে এ কথা বলা যায় যে আগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হতো শিক্ষার প্রসার ও সমাজের নানা অসংগতিকে তুলে ধরার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যই মুখ্য। প্রতিবছর বাড়ছে প্রকাশক ও প্রেসমালিকের সংখ্যা। এ দেশের সংবাদপত্র, পুস্তক প্রকাশনা এবং অন্যান্য প্রকাশনার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। তবু প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমরা বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারিনি, এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখেছি, প্রতিবছরই বাড়ছে প্রেসের সংখ্যা, কিন্তু মোট প্রেসের তুলনায় অনুমোদিত প্রেসের সংখ্যা খুবই কম।
সবকিছুর পরও জেগে থাকে আশা, বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প একদিন পৌঁছাবে অনন্য উচ্চতায়।
সূত্র: মহিউদ্দিন আহমেদের বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশনা, ফজলে রাব্বির ছাপাখানার ইতিকথা, মুনতাসীর মামুনের উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের মুদ্রণ ও প্রকাশনা ও খান মাহবুব সম্পাদিত গ্রন্থচিন্তন।