মহাজাগতিক আত্মপরিচয়ের খোঁজে
১৯ এপ্রিল ১৯৫৫। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট–এ একটা কার্টুন ছাপা হয়। তাতে গোটা সৌরজগতের ছবি। সেখানে পৃথিবী নামের ছোট্ট গোলকটিতে লেখা, ‘আলবার্ট আইনস্টাইন লিভড হেয়ার’। আগের দিন, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল প্রয়াত হয়েছেন সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এর চেয়ে ভালো উপায় বোধ হয় আর ছিল না। আইনস্টাইকে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করতে গিয়ে মানবসভ্যতার এক মহাসত্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কার্টুনটি—পৃথিবীতে মানুষ নামের প্রাণীটির একক আধিপত্য। কিন্তু মহাজাগতিক বিশলতার নিরিখে আমাদের আত্মপরিচয় কী? আইনস্টাইন যেখানে বাস করতেন, আমরাও সেখানে বাস করছি, এই কি আমাদের পরিচয়, আমাদের গর্বের জায়গা? ব্যাপারটা অনেকটা এমন: ভিনদেশে গিয়ে নিজের নাম বলার পরও যখন কোনো ব্যক্তি আপনার দেশটিকে চিনবে না, তখন আপনি বলবেন, এটা সেই বাংলা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বাস করতেন। লোকটি তখন আপনাকে চিনবে, হয়তো হেসে দুটি কথাও বলবে। রবীন্দ্রভূমে নিজের জন্ম ভেবে গর্বের ঢেকুরও তুলবেন আপনি। মহাবিশ্বে আমাদের পরিচয়ও কি তেমন? মহাবিশ্বের মহারহস্য যিনি উন্মোচন করেছেন বিজ্ঞানের বিশাল ক্যানভাস আর গণিতের রংতুলিতে, তাঁর আবাসস্থল পৃথিবী নামের গ্রহটিতে বাস করাই কি মানবজন্মের সার্থকতা? বিজ্ঞানের সঙ্গে খানিকটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বিষয়টা আদতে তেমনই দাঁড়ায়। মহাবিশ্বের বিশলতার মাপকাঠিতে আমরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণী বই তো কিছু নই!
মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান যত ক্ষুদ্রই হোক, এর জন্ম-মৃত্যু, ভূত-ভবিষ্যৎ জানার অধিকার আমাদের আছে। আর সেই অধিকারের জায়গা থেকেই নিউটন-আইনস্টাইনের মতো মহাবিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের মহারহস্য যেমন উন্মোচন করেছেন, তেমনি বাতলেছেন মহাজগতে মানুষের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার পথও। সেই পথে হেঁটেই আলো হাতের যাত্রীরা সেই সুদূর নীহারিকা, গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র, তথা গোটা ব্রহ্মাণ্ডের গোপন সূত্রের সুলুকসন্ধান করে চলেছেন। আর তাতেই নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে ফেরার বিষয়টাও সামনে চলে আসছে বারবার।
আমাদের দেশে চোখে পড়ার মতো মহৎ বিজ্ঞানসাহিত্য খুব বেশি রচিত হয়নি কেন? মোটাদাগে এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, গবেষকদের সাহিত্যভীতি আর সাহিত্যিকদের বিজ্ঞানভীতি। এই দুষ্টচক্রের পাকদণ্ডিতে পড়ে এ দেশের বিজ্ঞানসাহিত্য ঠিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি এখনো। তবু সাহিত্যমান ঠিকঠাক রেখে বেশকিছু গবেষক, অধ্যাপক এখানকার বিজ্ঞানসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। সেই ধারারই নবতম সংযোজন মানুষের মহাজাগতিক পরিচয়। সাহিত্যিক হিসেবে আহমাদ মোস্তফা কামাল বহুদিন আগেই দেশের সিরিয়াস পাঠকের মন জয় করেছেন। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তবে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের যুগল জিয়নকাঠি হাতে থাকার পরও তিনি বিজ্ঞানসাহিত্য রচনায় ব্রতী হলেন একটু দেরিতেই।
মানুষের মহাজাগতিক পরিচয় বইটার বিষয়বস্তু পদার্থবিদ্যা হলেও এটা তথ্য আর তত্ত্বের ভারে জেরবার নয়। সামান্য কিছু গণিতের ছোঁয়া থাকলেও সেটুকু সাধারণ পাঠকের কাছে ভীতিজাগানিয়া হবে না, এ নিশ্চয়তা দেওয়াই যায়। মোট আটটি অধ্যায়ে সাজানো এই বইয়ে পদার্থবিদ্য ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে সহজ-সাবলীল গদ্যে। প্রতিটা অধ্যায়েই উঠে এসেছে কিছু দার্শনিক প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের গভীরে ঢুকে লেখক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করেছেন। তাই মানুষের মহাজাগতিক পরিচয় বইটি আটপৌরের বিজ্ঞান থেকে বেরিয়ে মহৎ ননফিকশন সাহিত্যে পরিণত হওয়ার দাবি রাখে। লেখককে ধন্যবাদ এমন একটি বই লেখার জন্য।
আমাদের মহাজাগতিক পরিচয়
আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমদ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: মে ২০১৯
১০৪ পৃষ্ঠা, দাম: ২২০ টাকা।