আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি, এই কিছুদিন আগেও তাদের জন্য কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা ছিল একটি প্রাত্যহিক বিষয়। মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ কাঠকয়লার ব্যবহার শিখেছে। এই অতি সাধারণ কাঠকয়লার ব্যবহার প্রাচীন গুহার চৌহদ্দি পেরিয়ে উত্তরাধুনিক শিল্পকলায়ও স্থান করে নিয়েছে স্বপ্রতাপে। আর প্যাস্টেল কথাটির অর্থ হচ্ছে ছবি আঁকার রঙিন খড়ি। ড্রাই ও অয়েল প্যাস্টেল ব্যবহার করে থাকেন শিল্পীরা। গ্রাফাইটের সঙ্গে পরিমাণমতো মাটি মিশিয়ে আবিষ্কৃত আধুনিক পেনসিলের সিসের ব্যবহারও প্রাচীন। চারকোল, প্যাস্টেল ও পেনসিল—তিনটি মাধ্যমের করণকৌশল বা আঙ্গিকগত দিক থেকে মিল থাকলেও শিল্পীরা নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রতিটির ব্যবহার এবং সৃষ্টিকুশলতাকে পৃথক মাত্রা দিয়েছেন।
গ্যালারি কায়ার চলমান এ প্রদর্শনীতে এই তিন মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা। তবে এর মধ্যে চারকোলের আধিক্য বেশি। বেশির ভাগ শিল্পের চিত্রপটের বিভায় আছে চারকোল। প্রদর্শনীতে অগ্রজপ্রতিম শিল্পী মুর্তজা বশীরের ‘রেনেসাঁস’ ছবিটি সাদাকালো প্যাস্টেলে চিত্রিত। চিত্রটি একটু কিউবিজম ধারায় আঁকা হয়েছে। একটি মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্জাগরণকে প্রত্যক্ষ করেছেন শিল্পী।
সমরজিৎ রায়চৌধুরীর রেখাচিত্রে দেখা যাচ্ছে একটি নারীকে যে প্রোফাইল ভঙ্গিতে আছে। সমগ্র চিত্রতলজুড়ে বিম্বিত হয়ে আছে বিষণ্নতার অন্তধ্বনি। হাশেম খানের চারকোলে আঁকা ‘মিউজিক’ শিরোনামের ছবিতে পাখির কলতান, নারী এবং পাখির সুরছন্দ কথোপকথন মূর্ত হয়ে উঠছে। আবার রফিকুন নবীর ছবিতে দেখা যায়, কাটা লাল ঘুড়িটি একটি গাছে আটকে আছে।
হামিদুজ্জামানের দুটি ছবিই মিশ্রমাধ্যমে আঁকা-চারকোল ও প্যাস্টেলে। একটি ডকইয়ার্ড অন্যটি নিরাভরণ প্রতিকৃতি। আবদুস শাকুরের ‘ড্রয়িং-২’–এ দেখা যাচ্ছে দুই সখী কিছু একটা দেখছে। দুজনের একজন অন্দরমহলে, অন্যজন বাইরে।
নাজলী লায়লা মনসুরের দুটি ছবি হচ্ছে রিকশার আত্মচরিত। একটি চিত্রভূমিতে চারকোলের কর্ষণে রিকশাওয়ালার জীবনের দহনদাহের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বিধৃত করেছেন শিল্পী। একজন পরিশ্রান্ত রিকশাওয়ালা ঘুমিয়ে আছে, ওপর থেকে আধেক চাঁদ নেমে আসছে জ্যোৎস্নার আলোয় ধুয়ে দিতে। কাক মনে হয় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পাহারায় নিমগ্ন। আরেকটা ছবিতে একটি নারী উঁকি দিচ্ছে পেছনে।
মোহাম্মদ ইউনুসের ছবিতে বিমূর্ত বা নির্বস্তুক চিত্রশৈলীর উপস্থিতি সব সময় লক্ষণীয়। এই প্রদর্শনীতে ‘রেস্ট’ শিরোনামের চিত্রে চারকোলে কালো-হলুদের বর্ণবিন্যাস, কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কালো ডট এবং নিচের ভূমিতে কাগজের শুভ্রতার বিবর্ণ রূপ ছড়িয়ে আছে।
বিশ্বজুড়ে যখন অশান্তির কালো মেঘের ঘনঘটা, তখনই জামাল আহমেদের একঝাঁক কবুতর গ্যালারিজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে শান্তির আবহ। তাঁর প্যাস্টেল চালানোর চাতুরী অপরূপ। রণজিৎ দাসের ছবিতে উঠে এসেছে তিনটি আদিবাসী নারীর তিনটি আদল। মোস্তাফিজুল হকের মোরগের মধ্যে আছে তর্জন-গর্জন।
প্রদর্শনীতে আরও যেসব শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা হলেন কাজী রাকিব, রেজাউন নবী, আহমেদ শামসুদ্দোহা, সাইদুল হক, শেখ আফজাল, কারু তিতাস, গৌতম চক্রবর্তী, মোহাম্মদ ইকবাল, আনিসুজ্জামান, অনুকূল চন্দ্র
মজুমদার, কামালুদ্দিন, শাহনূর মামুন—এঁদের প্রত্যেকের অনবদ্য সৃষ্টিতে উত্তরার গ্যালারি কায়ার এই দলগত প্রদর্শনীতে যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে কয়লা-প্যাস্টেল-পেনসিলের এক অনন্য যূথাচার।
২৭ এপ্রিল শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ১১ মে পর্যন্ত।