জার্মানির ছোট শহর ওয়েইমারে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি ভিন্ন রকম শিল্প শিক্ষালয়। এখানে চিত্র–ভাস্কর্যের সঙ্গে স্থাপত্য, কারু ও ব্যবহারিক শিল্পের একটি সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল অভিজাত শিল্পকে জীবনের আরও কাছাকাছি সম্পৃক্ত করা, নিত্যদিনের প্রয়োজনীয়তার সহযোগী করে তোলা। স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্যতা একটি প্রধান বিবেচনা হওয়ায় এখানে প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে শিল্পের যোগসূত্রের অন্বেষা আরও জরুরি। ফলে এমন চিন্তা যে একজন স্থপতিকেই সর্বাগ্রে আন্দোলিত করবে, সেটি স্বাভাবিক। স্থপতি ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস (১৮৮৩–১৯৬৯) ১৯১৯ সালে ওয়েইমারের ‘স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের’ মাস্টার (প্রধান) নিযুক্ত হন এবং এটিকেই পরে তিনি বিশ্বখ্যাত বাউহাউসে রূপান্তরিত করেন।
এ ঘটনার প্রেক্ষাপটটিও হয়তো প্রণিধানযোগ্য। সময়টি অস্থিরতার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। ইউরোপজুড়ে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন, অর্থনীতি বিপর্যস্ত, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। সর্বত্র অস্থিরতা, চিত্র-ভাস্কর্যে এসে লাগছে তার ঢেউ। যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় দৃশ্যকলায় তখন নবতর বিন্যাস অন্বেষণের আকুতি। চিত্রকলায় এক্সপ্রেশনিজম আন্দোলন জার্মানিতেই বিকশিত হয়েছিল, তার বহিরঙ্গের ললিত-সৌন্দর্যবিরোধী সংঘাতময় রগরগে বর্ণের তীব্র আবেদন গ্রোপিয়াসকে আকর্ষিত করলেও একই সঙ্গে শিল্পের সঙ্গে বাস্তব জীবনযাপনের একটি সম্পর্ক রচনার প্রয়োজনীয়তা তাঁকে অধিক ভাবিত করেছিল। এই ভাবনার পেছনে নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ১৯১৭ সালে মহাযুদ্ধের মধ্যেই ঘটে যাওয়া রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। রুশ বিপ্লবের ফলে সোভিয়েত দেশে কনস্ট্রাকটিভিজম আন্দোলনে চিত্র-ভাস্কর্য-স্থাপত্যকে ব্যবহার্য জীবনের অনুসঙ্গী করে তোলার সমসাময়িক প্রয়াসটি তাঁকে অধিক অনুপ্রাণিত করে থাকবে।
বাউহাউস দৃশ্যকলার একটি ভিন্নতর প্রকল্প হাজির করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেললেও নানা প্রতিকূলতার কারণে তাকে বারবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে নাৎসি শক্তির উত্থানে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাউহাউসকে তিন স্থানে কাজ করতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠাস্থান ওয়েইমারে ১৯১৯ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত চলার পর এটি স্থানান্তরিত হয় আরেকটি ছোট শহর দেসাউয়ে, এখানে ১৯২৫ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত এটি চালু ছিল, এরপর ১৯৩২-এ স্থানান্তরিত হয় বার্লিনে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলন ছাড়াও জুরিখ ও প্যারিসভিত্তিক ডাডার ধ্বংসাত্মক দর্শন ও কর্মকাণ্ড পরবর্তীকালের শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করে। ডাডা আন্দোলন জার্মানিতে অতটা শক্তি অর্জন না করলেও গেয়র্গ গ্রোৎজ, অটো ডিক্স প্রমুখ শিল্পী এ থেকে প্রকাশের ভিন্নমাত্রিক রসদ পান। এসব কর্মকাণ্ডের ভেতর বাউহাউসকে কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদবিরোধীদের ঘাঁটি হিসেবে সন্দেহের চোখে দেখা হতে থাকে। সরাসরি বন্ধ করা না হলেও অব্যাহত চাপের মুখে ১৯৩৩ সালে কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়, শিল্পীদের অনেকেই দেশত্যাগ করেন। তবে স্থাপনের শত বছর পরও এর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব যে ক্ষুণ্ন হয়নি, তার প্রমাণ বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘর ও গ্যালারিতে বছরব্যাপী বাউহাউস শতবার্ষিকী পালনের ব্যাপক আয়োজন।
জার্মান স্থপতি ও বাউহাউসের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস ১৯২৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও নীতিনির্ধারক ছিলেন। পরবর্তী পরিচালক নিযুক্ত হন সুইস স্থপতি হানেস মেয়ার (১৯২৮–১৯৩০)। সর্বশেষ পরিচালক লুডউইগ মিয়েস ভ্যান ডার রোহে একজন জার্মান-আমেরিকান স্থপতি, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩-এ বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির তিন পরিচালকই স্থপতি।
নব্যধারার স্থাপত্যশিল্পে বাউহাউসের অবদান অন্যতম হলেও সূচনার প্রথম কয়েক বছর এখানে পৃথক স্থাপত্য বিভাগ ছিল না। অবশ্য বাউহাউসের উদ্দেশ্যই ছিল চারু ও কারুশিল্প, ব্যবহারিক শিল্প ও স্থাপত্যের সমন্বয়ে একটি সার্বিক শিল্পচেতনা ও চর্চাক্ষেত্র গড়ে তোলা। বিশেষ করে এর স্থাপত্য, আসবাবশিল্প, মৃৎশিল্প, অভ্যন্তরসজ্জা, বুনন ও মুদ্রণবিষয়ক ডিজাইনে যে সরলীকৃত আধুনিকতার প্রকাশ ঘটেছিল, তার অভিঘাত বিশ্বময় অনুভূত হয়েছিল।
ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস নিজে ছিলেন স্বনামধন্য স্থপতি। তিনি অনেক উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যেরও নকশাকার, পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। এ সত্ত্বেও গ্রোপিয়াস শিল্পের সমন্বিত শিক্ষা ও চর্চার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর সময়কালে বাউহাউসে নিয়োগ পান জোহানেস ইটেন, পল ক্লি, ওয়াসিলি কান্দিনিস্কি, লাজলো মহলি-ন্যাগির মতো বিবিধ শিল্পশাখার খ্যাতিমান শিক্ষককেরা। এটি লক্ষণীয়, বাউহাউসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিচালক ও প্রভাবশালী শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে, ফলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এর বৈশিষ্ট্যেও বিভিন্নতা প্রকাশ পেয়েছে। হানেস মেয়ার দেসাউ বাউহাউসের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ওয়াল্টার গ্রোপিয়াসের সমন্বয়ধর্মী ধারা থেকে সরে এসেছেন। আবার লুডউইগ মিয়েস ভ্যান ডার রোহে প্রতিষ্ঠান-প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে একে পুরোপুরি বেসরকারি শিল্পবিদ্যালয়ে রূপ দেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত জোহানেস ইটেনই ছিলেন পাঠ্যবিষয়ের প্রধান প্রণয়নকারী। তিনি জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের মিউনিখ ধারার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং তাঁর উদ্যোগেই এ আন্দোলনের পুরোধা ওয়াসিলি কান্দিনিস্কি এখানে শিক্ষক নিযুক্ত হন।
বাউহাউসের শতবার্ষিকীতে দৃশ্যকলার একটি সন্ধিক্ষণে এর প্রাসঙ্গিকতা গুরুত্বপূর্ণ। বলা যেতে পারে, বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে একটি বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে বিপর্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিমা নান্দনিক ভাবনায় উচ্চ শিল্প (ফাইন আর্টস) আর গৌণ শিল্পকে (মাইনর আর্টস) উঁচু ও নিচু মর্যাদায় ভিন্ন করে দেখার প্রবণতাই মুখ্য ছিল। বাউহাউস উচ্চ শিল্পকে ব্যবহারিক জীবনে সম্পৃক্ত করার কথা ভাবতে গিয়ে প্রায়োগিক শিল্প, কারুশিল্পের মতো নানান গৌণ শিল্পকে শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করল। স্থাপত্য তো একটি প্রধান বিবেচনা থাকল। এ ছাড়া আসবাবশিল্প, মৃৎশিল্প, অভ্যন্তরসজ্জা, বুনন ও মুদ্রণবিষয়ক শিক্ষাকে মূল শিল্পশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দৃশ্যকলার শিক্ষাব্যবস্থায় এ প্রতিষ্ঠান একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল। বিশেষত স্থাপত্য ও আসবাব নকশায় যে একটি সরলীকৃত আধুনিকতার বিকাশ সূচিত হয়েছিল, তার প্রভাব উভয় ক্ষেত্রেই এখনো প্রত্যক্ষ রয়েছে। বাউহাউসের সরল জ্যামিতিক নকশার আসবাবের উদাহরণ যেমন জাদুঘরে সংরক্ষিত বা বইয়ের পাতায় মুদ্রিত রয়েছে, তেমনি এর প্রভাব সমসাময়িক আসবাবশিল্পে এখনো ব্যাপক। এর স্থাপতিক সারল্য পরবর্তী স্থাপত্যধারায় আরও বড় প্রভাব হিসেবে কাজ করছে।
আমাদের জন্য শ্লাঘার একটি বিষয় হচ্ছে ১৯২২ সালে, প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায়, কলকাতায় বাউহাউসের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা ছিল প্রাচ্যের কোনো দেশে পশ্চিমা কোনো শিল্পশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিল্পশৈলীর প্রথম প্রদর্শনী। এতে কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পীরাও অংশ নেন। ফলে এটি হয়ে ওঠে আধুনিক কালে পূর্ব ও পশ্চিমের সমসাময়িক শিল্পের প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ হিসেবে অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা। গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করলেও এর বাস্তবায়ন শিল্পবিশেষজ্ঞ স্টেলা ক্রামরিশ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ছাড়া হয়তো সম্ভব হতো না। বিংশ শতকের প্রথম পাদে পূর্ব-পশ্চিমের বিনিময়ের যে প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল, তার গুরুত্ব পরবর্তীকালে পশ্চিমে স্বীকৃত হয়েছে। বাউহাউসের কলকাতা প্রদর্শনীর স্মারক হিসেবে দেসাউ বাউহাউস ভবনে ১৯২২ সালে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ২৭ মার্চ থেকে ৩০ জুন ২০১৩ একটি প্রদর্শনী হয়ে গেছে। পূর্ব-পশ্চিমের দৃশ্যশিল্পের এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ নিয়ে গবেষণাকর্মও চলমান রয়েছে। ফলে বাউহাউসের ব্যতিক্রমী উদ্যোগের সূচনার শতবর্ষ আমাদের জন্য আরও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।