মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও
তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়
লেখক: জহিরুল ইসলাম
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
দাম: ৩৫০ টাকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর কোনো কাছের ব্যক্তিকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ হোক কাল হোক, মুক্ত হবেই। তবে যেই দেশটি আমরা স্বাধীন করতে যাচ্ছি, সেই দেশটি কি আমাদের বাসযোগ্য হবে?’ ১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বরের পর তাজউদ্দীনের এই মন্তব্য আমরা বিশেষভাবে অনুধাবন করেছি, আজও করে যাচ্ছি। তাজউদ্দীনের কথার পাশাপাশি খালেদ মোশাররফের কথাও এসে যায়। তিনি নাকি বলেছিলেন, যুদ্ধে বিজয়ী দেশ তার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিত রাখে না। ইতিহাসে তা-ই দেখা গেছে; পৃথিবীর অনেক স্থানে।
বিজয়ী দেশের সাহসী সন্তানেরা যে বেঁচে থাকেন না অথবা বাঁচতে পারেন না, তার প্রমাণ ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলি। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, খালেদ মোশাররফ, খন্দকার নাজমুল হুদা এবং এ টি এম হায়দার—সবাই প্রাণ দিলেন বিদেশি দেশের ও প্রতি বিপ্লবীদের হাতে। এ বিষয়টি পুনরায় উঠে এসেছে জহিরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায় বইয়ে। হায়দারের কথা শুধু এক বিশেষ ব্যক্তির কথা নয়। যে মানুষটির জীবন ও কর্ম লেখক এই বইয়ে তুলে ধরেছেন, সে কাহিনি গোটা জাতির। এক কথায় বলতে গেলে, এ টি এম হায়দার আমাদের সবার জীবনের সেই সাহসিকতা-সংবলিত অধ্যায়ের প্রতিনিধি যে সাহসিকতার পরিচয় আমরা মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছিলাম এবং পেয়েছিলাম। হ্যাঁ, ইতিহাস তার নায়কদের গ্রাস করে ফেলে। তবে সেটাই বা বলি কী করে? যদি এ কথাই স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে যারা ১৯৭৫ সালের আগস্ট-নভেম্বরে এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করল, তাদের তো ছাড় দেওয়া হয়ে যায়। সেটা আমরা করব কেন?
মেজর পরবর্তী সময়ে কর্নেল—হায়দার দেশের টানে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১-এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীতে যোগদান করা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা—এই ছিল তাঁর স্বপ্ন, সেই স্কুলজীবন থেকে। পরে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান ও সুদূর মুলতানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ সময় অন্য বাঙালিদের মতো তিনি অনুধাবন করতে পারেন, বাঙালিরা কী পরিমাণ বৈষম্যের শিকার পাকিস্তান রাষ্ট্রে। হায়দার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং সেই যুদ্ধে তিনি এক বিরল প্রতীক হয়ে আছেন, বিশেষ করে এ জন্য যে তিনি ওই সব ব্যক্তির অন্যতম, যাঁরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই ছবি একটি ইতিহাস হয়ে আছে আমাদের জন্য।
প্রশ্ন এসে যায়, কারা খালেদ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা করল এবং এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাদের হাত ছিল? সেই ৭ নভেম্বর ভোরে এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন দশম বেঙ্গলে, যা ছিল সেই মুহূর্তে শেরেবাংলা নগরে। দশম বেঙ্গলের আনুগত্য খালেদ মোশাররফের প্রতিই ছিল এবং স্বাভাবিকভাবে এই তিন কর্মকর্তা আশা করেছিলেন, তাঁদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু পাল্টে গেল সব। তাঁদের নিরস্ত্র করা হলো। কর্নেল নোয়াজেশ সদ্য মুক্ত জিয়াউর রহমানকে ফোনে জানান, খালেদ মোশাররফ, নাজমুল হুদা ও এ টি এম হায়দার দশম বেঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। জিয়া নাকি নোয়াজেশকে বলেছিলেন লক্ষ রাখতে, যেন তাঁদের কোনো ক্ষতি না হয়।
কথিত আছে, যে কক্ষে এই তিনজন যখন বন্দী ছিলেন, তখন কর্নেল তাহেরকেও সেখানে দেখা গিয়েছিল। তিনি অল্পক্ষণ পরে বেরিয়ে যান এবং এর কয়েক মিনিট পরেই একদল সেপাই এসে তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে ওই কক্ষেই হত্যা এবং বাকি দুজনকে বাইরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
লেখক হায়দারের জীবন ও মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে বিভিন্ন বইয়ের কথা বলেছেন, বিশেষ করে নীলুফার হুদা এবং এম এ হামিদ রচিত বই দুটির কথা। তাঁর আক্ষেপ, (এ আক্ষেপ আমাদের সবারও) আজ অবধি ৭ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার হলো না। হায়দারের মরদেহ ১২ নভেম্বর পর্যন্ত সিএমএইচে রাখা ছিল। তাঁর বড় বোন গিয়ে সেটি গ্রহণ করেন। একইভাবে খালেদ মোশাররফ ও নাজমুল হুদার পরিবারও তাদের প্রিয়জনদের মরদেহ গ্রহণ করে। সমাপ্তি ঘটে দেশের ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ের।
শেষে কেবল একটি প্রশ্ন থেকে যায়, এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকলে, তাঁদের অভ্যুত্থান সফল হলে দেশের বর্তমান অবস্থার সম্মুখীন কি আমাদের হতে হতো? ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মনে হয়েছিল, আমাদের জীবনে আবার বুঝি আলো ফিরে এল। সেই আলো নিভে গেল ৭ নভেম্বর ভোরে তথাকথিত সিপাহি-জনতা বিপ্লবের ঘন অন্ধকারের মধ্য দিয়ে।