বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জিন্দানখানা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমান কমেটে স্বদেশে পৌঁছান—এ কথা সবার জানা। এটাও অজানা নয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বাংলাদেশে আসার জন্য ভারত থেকে বিমান পাঠানোর প্রস্তাব দিলে তিনি তাতে রাজি হননি। বরং ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁকে দেশে ফেরার জন্য তারা যেন একটি বিমানের ব্যবস্থা করে। অবশ্য ব্রিটিশ বিমানে দেশে ফেরার পথে তিনি দিল্লি হয়ে আসেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চূড়ান্ত রূপ নেয়। ডিসেম্বরের ২০ তারিখে পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তিনি যখন দেখলেন, কোনোভাবে বাংলাদেশের বিজয়ী নেতাকে আটকে রাখা যাবে না, তখন তাঁকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৭ জানুয়ারি ১৯৭২–এর মধ্যরাতে অতিগোপনীয়তার সঙ্গে লন্ডনগামী পিআইএর একটি বিমানে বঙ্গবন্ধুকে তুলে দেওয়া হয়। ওই বিমানে ড. কামাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যাও ছিলেন। ৯ জানুয়ারি স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তখনো ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজের নির্বাচনী এলাকায় ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে ক্লারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কমেট বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় পৌঁছে দিয়ে ব্রিটেনে ফিরে যায়। তারপর ওই বিমান–সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু যে বিমানটির সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জড়িত, তার অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে কবি-গবেষক তারিক সুজাতের বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: কমেট বিমান ও ব্রিটিশ গোপন দলিল বইয়ে।
কমেটের কথা স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিবিজড়িত কমেট বিমানটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রায় ৫০ বছর আগের কয়েকটি উজ্জ্বল দিনকে ঘিরে বহু বিশিষ্টজনের স্মৃতি, দুর্লভ আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন সংবাদ, ভিডিও ফুটেজ, দায়িত্ব পালনরত অনেকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। অব্যাহত অনুসন্ধান ও গবেষণায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানতে পারেন যে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী সেই বিমান জার্মানির flugaussteling l+P জুনিয়র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
১৯৭৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বিমানটি বিক্রি করে দেয়। ইউনেসকোর নির্বাহী বোর্ডের সভায় যোগ দিতে তারিক সুজাত ২০২০ সালে প্যারিসে যান এবং সেখান থেকে জার্মানি যান বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বহনকারী বিমানটির খোঁজে। জাদুঘরের পরিচালক পিটার জুনিয়রকে তিনি বিমানটি বিক্রি করার প্রস্তাব দিলে তাঁকে জানানো হয়, এর অনেক যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে গেছে; উড্ডয়নের সম্ভাবনা নেই। এরপর তারিক সুজাত বিমানটি নিয়ে জাদুঘরেই এক প্রদর্শনীর আয়োজন করার প্রস্তাব দিলে পিটার রাজি হন। কথা ছিল ১০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্যারিসে যাবেন ইউনেসকো বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, তখন সেই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের প্রশাসনের কিছু লোকের অসহযোগিতার কারণে।
তারিক সুজাত সেদিন কমেট উড়োজাহাজটির ২৫ মিনিটের ভিডিও করেন। আইপ্যাডেও কিছু ছবি তোলেন, যা এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিমানের ভেতর-বাইরের কিছু ছবি ছাড়াও বইয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের কিছু ছবি। এ ছাড়া বইয়ে ব্রিটিশ সরকারের কিছু গোপন নথি, টেলিগ্রাম সন্নিবেশিত হয়েছে; যা বইয়ের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এই দুর্লভ মুহূর্ত দুই মলাটে ধারণের জন্য তারিক সুজাতকে ধন্যবাদ।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: কমেট বিমান ও ব্রিটিশ গোপন দলিল
তারিক সুজাত
প্রকাশক: জার্নিম্যান বুকস, ঢাকা,
প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২২,
প্রচ্ছদ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্র অবলম্বনে, ৩৮০ পৃষ্ঠা, দাম: ১৮০০ টাকা।