আমার সমরজিৎ স্যার
শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী অসুস্থ হয়ে এখন হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন তিনি।
সমরজিৎ স্যারের চেহারাটা মনে এলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ; মুখের সঙ্গে সঙ্গে চোখটিও হাসে। হ্যাঁ, সদা পরিপাটি এই মানুষই শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী। ১৯৮৫ সালে চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। তবে আমি তাঁকে চিনতাম আরও অনেক আগে থেকে। সেই পঞ্চাশ দশকে আমার বাবা শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী যখন চারুকলায় ভর্তি হন, এর কিছুদিন পর সমরজিৎ স্যারও ভর্তি হয়েছিলেন সেখানে। তখন থেকেই তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে বড় ভাই–ছোট ভাইয়ের এক আন্তরিক বন্ধন। সেই সূত্রে তিনি আমার সমরজিৎ কাকাও বটে। কিন্তু চারুকলায় ভর্তির পর থেকে তাঁকে ‘সমরজিৎ স্যার’ বলে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি, তিনিও পুত্রের মতো আমাকে স্নেহ দিয়েছেন, দিয়ে চলেছেন।
আমার সেই সমরজিৎ স্যার এখন অসুস্থ, বেশ অনেক দিনই হাসপাতালবাসী। কিন্তু স্যারের অসুস্থ মুখটি কখনো আমি কল্পনা করতে পারি না। তাঁকে নিয়ে যখন ভাবি, অসংখ্য স্মৃতি মনের মধ্যে যেন একটার পর একটা ওঠে আর নামে। আরেকটি দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে স্থিরচিত্রের মতো—কাপড়ের ব্যাগ কাঁধে, দুই হাত পেছনে দিয়ে চারুকলার করিডর ধরে ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি।
সে সময় খুব সম্ভবত আমি চারুকলার দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; একটি ক্লাস পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করার পরও সমরজিৎ স্যার আমাকে পঞ্চাশের মধ্যে আটাশ নম্বর দিলেন। এতে মনটা একটু খারাপ হলো আমার। বুঝতে পারলাম না, এত খেটেখুটে কাজ করার পরও কেন এমন নম্বর পেলাম! তো, একদিন চারুকলায় স্যারের সঙ্গে দেখা হতেই আমাকে তিনি বললেন, ‘তোমার কাজটা ভালো হয়েছে। তুমি আরও বেশি নম্বর পেতে। কিন্তু কাজটার মধ্যে অনেক কারেকশন (সংশোধন) করেছ।’
স্যারের এ কথা থেকেই আমি আমার কম নম্বর পাওয়ার রহস্য আবিষ্কার করলাম। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাফিক ডিজাইনে এখন যেমন অনেক কিছু করা যায়, আমাদের সময় তা ছিল না। আমরা কাজ করতাম ম্যানুয়ালি (হাতের মাধ্যমে)। ফলে এখানে দক্ষতার পাশাপাশি ধৈর্যেরও একটা বিষয় ছিল। আমার মধ্যে বোধ হয় ধৈর্যের কিছুটা ঘাটতি ছিল। এ জন্য কারেকশন ছিল বেশি। আর এ কারণেই নম্বর কমে গিয়েছিল। এ সময় স্যার আমাকে আরেকটি কথা বলেছিলেন, ‘তোমাকে আরেকটু মন দিতে হবে, আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে।’
খুব অল্প কথায় সমরজিৎ স্যার সেদিন আমাকে আমার খামতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমি শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। একজন কর্মনিষ্ঠ, প্রকৃত শিক্ষকের যা কর্তব্য, সেদিন তিনি তা–ই করেছিলেন। আমার সঙ্গে পারিবারিকভাবে তাঁর কী সম্পর্ক, তা নিয়ে ভাবেননি। পরে নানা সময়ে তাঁর কাছ থেকে আরও অনেক কিছু শিখেছি।
সমরজিৎ স্যার যেমন সৎ শিক্ষক, তেমনি নিষ্ঠ শিল্পী। তাঁর চিত্রকর্মের দিকে তাকালে দেখা যাবে, লোকশিল্প থেকে প্রেরণা নিলেও তিনি ছবির কম্পোজিশনগুলো করেছেন জ্যামিতিক বিন্যাসে। অধিকাংশ সময় তাঁর ছবিতে বিষয় হিসেবে এসেছে সাধারণ মানুষের জীবন। স্যারের ছবিগুলো খুব উজ্জ্বল। বিমূর্ততার মধ্যেও একধরনের মূর্ততা পাওয়া যায়। এসব করণকৌশলই শিল্পী হিসেবে সমরজিৎ রায়চৌধুরীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।
আসলে কি ব্যক্তিজীবন, কি শিল্পীজীবন—সমরজিৎ রায়চৌধুরী চিরকালই নিজের মতো—নিজস্ব মুদ্রাগুণে আলাদা।
‘একে একে নিভিছে দেউটি’, আমাদের মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে যাচ্ছে। যাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ নেব, যাঁরা ভরসা দেবেন, এমন মানুষ তো আর খুব বেশি নেই। সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আমার সমরজিৎ স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। তাঁর ছায়াতলে আরও কিছুকাল থাকতে চাই।