যেভাবে অনূদিত হলো বঙ্গবন্ধুর বইগুলো

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’–এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ও ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টির পরিচালক ফকরুল আলম। তিনি লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর বইগুলো অনূদিত হওয়ার নেপথ্য কাহিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫ )
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

তখন সম্ভবত ২০০৬ সাল। আমার বন্ধু অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ আমাকে একদিন বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী নামের পাণ্ডুলিপিটি বই হয়ে বের হবে। বইটি আমি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে পারব কি না।

আমার কাছে প্রস্তাবটি ছিল মেঘ না চাইতে জলের মতো। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’, ব্যাপারটি আমার জন্য ছিল অনেকটা সে রকম।

তরুণ বয়স থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত, তাঁর ভক্তও। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ কামাল আমার ব্যাচমেট ও বন্ধু ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন দুই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আমরা। আমি ইংরেজি বিভাগে আর শেখ কামাল ভর্তি হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। তখন থেকেই আমরা একে অপরের কাছাকাছি এসেছিলাম। ফলে কাজী শহীদুল্লাহ, এখন যিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, তিনি সেদিন যখন আমাকে এমন একটি অভূতপূর্ব প্রস্তাব দিলেন, আমার রাজি না হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। ভাবলাম, কোন ভাগ্যে আমার কাছে এমন দারুণ একটা সুযোগ এল!

কাজী শহীদুল্লাহও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধু ও ব্যাচমেট, পড়তেন ইতিহাস বিভাগে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল আমরা সহকর্মী হিসেবেও কাজ করেছি। আমাদের মধ্যে অনেককালের ঘনিষ্ঠতা। আর তত দিনে আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করে ফেলেছি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করছি এবং তা নিয়মিতভাবে দ্য ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব কারণে শহীদুল্লাহ আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন কি না জানি না। তবে যে কারণেই দেন না কেন, কাজটি করতে আমি তৎক্ষণাৎ সম্মত হলাম। এমন একটি প্রকল্পে কাজ করতে পারব ভেবে শিহরিতও হলাম।

আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী, থাকেন ধানমন্ডির সুধা সদনে। ঠিক হলো, এ কাজের ব্যাপারে সুধা সদনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হবে। সেই সময়ই জানলাম, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক প্রথিতযশা মানুষ—ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, লোকসাহিত্যবিদ শামসুজ্জামান খান ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ। আর পুরো কাজটি তত্ত্বাবধান করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর বোন শেখ রেহানা।

পরে সুধা সদনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজের ব্যাপারে কথা হলো। কথা হলো এই প্রকল্পের অন্যদের সঙ্গেও। এ সময়ই অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ বঙ্গবন্ধুর আরও দুটি পাণ্ডুলিপির (কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন) ব্যাপারে বিস্তারিত জানার সুযোগ পেলাম। জানলাম, সেই ২০০০ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর লেখাপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ চলছে এবং এ কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন আরেক বরেণ্য ব্যক্তি—যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনায়েতুর রহিম। তিনি বঙ্গবন্ধুর লেখার ইংরেজি অনুবাদের কাজও শুরু করেছিলেন।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখেছেন। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি:

‘ইতোমধ্যে ২০০০ সাল থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর লেখা স্মৃতিকথা, নয়াচীন ভ্রমণ ও ডায়েরি প্রকাশের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আমেরিকার জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এনায়েতুর রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর উপর গবেষণা করতে। বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা—এই বিষয়টা ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। তিনি মাহাবুবউল্লাহ-জেবুন্নেছা ট্রাস্ট কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়ার”-এ যোগ দেন “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” গবেষণার জন্য। এই গবেষণা কাজ করার সময় বঙ্গবন্ধুর জীবন, স্মৃতিকথা ও ডায়েরি নিয়েও কাজ শুরু করেন। আমি ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ তাঁকে সহায়তা করি। ড. এনায়েতুর রহিম বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুতে এই কাজে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়।’

আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী, থাকেন ধানমন্ডির সুধা সদনে। ঠিক হলো, এ কাজের ব্যাপারে সুধা সদনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হবে। সেই সময়ই জানলাম, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক প্রথিতযশা মানুষ—ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, লোকসাহিত্যবিদ শামসুজ্জামান খান ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ। আর পুরো কাজটি তত্ত্বাবধান করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর বোন শেখ রেহানা।

এই প্রকল্পে—অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইংরেজি অনুবাদের কাজ আমি যখন শুরু করি, এর কাজ তখন অনেক দূর এগিয়েছে। মনে আছে, প্রাথমিকভাবে আমাকে ত্রিশ পৃষ্ঠা অনুবাদের জন্য দেওয়া হয়েছিল।

আমি অনুবাদ করলাম। সেই অনুবাদ ঠিকঠাক আছে কি না, তা নিরীক্ষণ করা হলো। তারপর দেওয়া হলো আরও ত্রিশ পৃষ্ঠা। এভাবে ত্রিশ পৃষ্ঠা, ত্রিশ পৃষ্ঠা করে চলছিল অনুবাদের কাজ। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে বের করা হবে বইটি। তাই কাজটি চলছিল দলগতভাবে। পাণ্ডুলিপি থেকে বই করার যে কর্মযজ্ঞ, তাতে প্রত্যক্ষভাবে আমি কাজ করেছি শামসুজ্জামান খান—জামান ভাই ও বেবী মওদুদ—বেবী আপার সঙ্গে। আর আগেই বলেছি, আমাদের এই পুরো দলকে ঘনিষ্ঠভাবে তত্ত্বাবধান করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী, তখন আমরা কাজ করতাম সুধা সদনে বসে। সেখানে নিয়মিতই আমাদের বৈঠক হতো, কাজ চলত।

এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করা হলে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়ে। এ সময় বেবী আপাসহ আমরা টুকটাক কিছু কাজ করেছি বিচিত্রা অফিসে বসে।

পরে ২০০৮ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। এরও বেশ কিছুদিন পর আমাদের কাজ আবার জোরেশোরে শুরু হলো। আমরা তখন প্রতি সপ্তাহেই কাজটি নিয়ে বসতাম—জামান ভাই, বেবী আপা আর আমি। এ সময় রাষ্ট্রীয় শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের বৈঠকগুলোয় উপস্থিত থেকে আমাদের নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই কাজকে যে তিনি কতটা অগ্রাধিকার দিয়েছেন, এ থেকেই তা বোঝা যায়।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী অনুবাদ করার সময় আমি ফুলার রোডস্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে থাকি। সাধারণত অনুবাদের কাজটি করতাম সকালের দিকে। বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো একবার, দুইবার—বারবার পড়তাম। তারপর অনুবাদ করতাম। পরে সেই অনুবাদ আবার নিজেই সম্পাদনা করতাম। এভাবে দিনের পর দিন কাজ চলেছে। বঙ্গবন্ধুর লেখা অনুবাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল, তিনি যেভাবে গল্প বলার ভঙ্গিতে, মুখের ভাষায় লিখে গেছেন, অনুবাদেও সেই সুর ও বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখা।

অনুবাদ করার সময় আমি সেই চেষ্টাই করেছি। কাজ করতে করতে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যেত, টের পাওয়া যেত না। আমার বাসার জানালা থেকে দেখা যেত ফুলার রোডের রেইনট্রিগুলো। শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা পড়তে পড়তে কখনো কখনো যদি সেই গাছ—বাতাসে দোল খাওয়া গাছের পাতার দিকে চোখ যেত, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আমার কাছে যেন নিমেষেই একাকার হয়ে যেত। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে ভাবতাম, বঙ্গবন্ধু এত সাবলীল, আন্তরিক আর মুখের ভাষায় তাঁর জীবনকথা লিখেছেন, মনে হচ্ছে পাশের বাড়ির কেউ নিজের জীবনের গল্প করতে বসেছেন।

পাণ্ডুলিপি থেকে বই করার যে কর্মযজ্ঞ, তাতে প্রত্যক্ষভাবে আমি কাজ করেছি শামসুজ্জামান খান—জামান ভাই ও বেবী মওদুদ—বেবী আপার সঙ্গে। আর আগেই বলেছি, আমাদের এই পুরো দলকে ঘনিষ্ঠভাবে তত্ত্বাবধান করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এটা তো জানা কথা যে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৬৬ সালে কারারুদ্ধ হওয়ার পর। লিখেছিলেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত নিজের জীবনের গল্পগুলো এখানে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছিলেন তিনি। পরে তাঁর লেখার খাতাটি হারিয়ে যায়। সেই খাতা আবার পাওয়াও যায় নাটকীয়ভাবে। বইয়ের ভূমিকায় খাতা উদ্ধার ও বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই ভাষ্য যখন অনুবাদ করছিলাম, তাঁর মর্মস্পর্শী লেখাটি দারুণভাবে স্পর্শ করেছিল আমাকে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর লেখা ভূমিকা থেকে এখানে খাতা উদ্ধার থেকে পাণ্ডুলিপি তৈরির অংশটুকু তুলে ধরছি:

‘যখন “স্মৃতিকথা” ও “ডায়েরি”র কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, সেই সময় আমার হাতে এল নতুন চারখানা খাতা, যা আত্মজীবনী হিসেবে লেখা হয়েছিল। এই খাতাগুলো পাবার পিছনে একটা ঘটনা রয়েছে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ চব্বিশজন মৃত্যুবরণ করেন। আমি আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যাই। এই ঘটনার পর শোক-কষ্ট-বেদনায় যখন জর্জরিত ঠিক তখন আমার কাছে এই খাতাগুলো এসে পৌঁছায়। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝেও যেন একটু আলোর ঝলকানি। আমি ২১ আগস্ট মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। মনে হয় যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আর সেই সময় আমার হাতে এল আব্বার হাতের লেখা এই অমূল্য আত্মজীবনীর চারখানা খাতা! শেষ পর্যন্ত এই খাতাগুলো আমার এক ফুফাতো ভাই এনে আমাকে দিল। আমার আরেক ফুফাতো ভাই বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে এই খাতাগুলো পেয়েছিল। সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এই চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও শাহাদাৎ বরণ করায় তা করতে পারেন নাই। কাজটা অসমাপ্ত রয়ে যায়।

‘খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। [...]

‘আব্বার হাতে লেখা চারখানা খাতা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। খাতাগুলোর পাতা হলুদ, জীর্ণ ও খুবই নরম হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় লেখাগুলো এত ঝাপসা যে পড়া খুবই কঠিন। একটা খাতার মাঝখানের কয়েকটা পাতা একেবারেই নষ্ট, পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। পরদিন আমি, বেবী মওদুদ ও রেহানা কাজ শুরু করলাম। রেহানা খুব ভেঙে পড়ে যখন খাতাগুলো পড়তে চেষ্টা করে। ওর কান্না বাঁধ মানে না। প্রথম কয়েক মাস আমারও এমন হয়েছিল যখন স্মৃতিকথা ও ডায়েরি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে মনকে শক্ত করেছি। প্রথমে খাতাগুলো ফটোকপি করলাম। আবদুর রহমান (রমা) এই কাজে আমাদের সাহায্য করল। খুবই সাবধানে কপি করতে হয়েছে। একটু বেশি নাড়াচাড়া করলেই পাতা ছিঁড়ে যায়। এরপর মূল খাতা থেকে আমি ও বেবী পালা করে রিডিং পড়েছি আর মনিরুন নেছা নিনু কম্পোজ করেছে। এতে কাজ দ্রুত হয়েছে। হাতের লেখা দেখে কম্পোজ করতে অনেক বেশি সময় লাগে। সময় বাঁচাতে এই ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও লেখার পাঠ অস্পষ্ট। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে চারখানা খাতার সবটুকু লেখাই কম্পিউটারে কম্পোজ করা হয়েছে। খাতাগুলোতে জেলারের স্বাক্ষর দেয়া অনুমোদনের পৃষ্ঠা ঠিকমতো আছে। তাতে সময়টা জানা যায়।

‘এরপর আমি ও বেবী মওদুদ মূল খাতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে সম্পাদনা ও সংশোধনের কাজটা প্রথমে শেষ করি। তারপর অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আমি ও বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপির সম্পাদনা, প্রুফ দেখা, টীকা লেখা, স্ক্যান, ছবি নির্বাচন ইত্যাদি যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করি। শেখ রেহানা আমাদের এসব কাজে অংশ নিয়ে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করে।

‘এই লেখাগুলো বারবার পড়লেও যেন শেষ হয় না। আবার পড়তে ইচ্ছা হয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য, একজন মানুষ কীভাবে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন, জেল–জুলুম–নির্যাতন সহ্য করতে পারেন তা জানা যায়।’

পাণ্ডুলিপি থেকে অসমাপ্ত আত্মজীবনী যখন বই আকারে প্রকাশের অবস্থায় এসেছে, তখন আমাদের দলের সঙ্গে বৈঠক করলেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) মহিউদ্দীন আহমেদ। সিদ্ধান্ত হলো, একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে বইটি বের করবে ইউপিএল। ২০১২ সালে বাংলাদেশের ইউপিএল, ভারতের পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকেও প্রকাশিত হলো বইটি।

এই বইয়ের পর বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীনও ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। অনুবাদের প্রক্রিয়াটি ছিল আগের মতোই—অর্থাৎ ভাগে ভাগে অনুবাদ করা হতো। পরে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ ও ১৯৫৪ সালে লেখা বই দুটি যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। দুটি বইয়ে বঙ্গবন্ধুর লিখনভঙ্গিমাও প্রথম বইয়ের অনুরূপ—মুখের ভাষায় গল্প বলার ঢঙে লেখা। এই বইগুলোর কাজ করতে করতে আরো উপলব্ধি করেছি যে বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি বই–ই আমাদের ইতিহাসের আকর। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ তথা এই অঞ্চল ও এখানকার মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এই বইগুলো বাংলা ও ইংরেজি—যেকোনো ভাষায় বাঙালিমাত্র সবারই পড়া উচিত।

জাতির পিতার আরও দুই–একটি ছোটখাটো অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি কি আছে? যদি পাওয়া যায়, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

এই বইগুলোর পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শামসুজ্জামান খান, বেবী মওদুদ আর আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিন একটি দল হয়ে কাজ করেছি—কত যে স্মৃতি আমাদের! আজ জামান ভাই নেই, বেবী আপাও নেই। বঙ্গবন্ধুর বইগুলোর কথা, প্রকল্পটির কথা মনে হলে তাঁদের কথা খুব মনে পড়ে। মনে হয় আরেকটি কথাও—শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন—তিনটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ যে আমি করেছি, এটা আমার জীবনের সৌভাগ্যের ঘটনাই শুধু নয়, সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাও।