বঙ্গবন্ধু আছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো থাকবেনই। আরও আছেন জীবনানন্দ দাশ, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, জয়নুল আবেদিন থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমীসহ অনেকেই। রঙে রেখার লাবণ্যে লালিত্যে তাঁদের প্রতিকৃতি এঁকেছেন আনিসুল হক। পাঠকেরা যে আনিসুল হককে খ্যাতনামা কবি, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক হিসেবে তাঁর লেখা পড়ে থাকেন, তিনিই এঁকেছেন অনেক কৃতী বাঙালির প্রতিকৃতি আর প্রকৃতির চিত্র।
আজ শুক্রবার ছুটির দিনের সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুরু হলো আনিসুল হকের আঁকা চিত্রকর্মের একক প্রদর্শনী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা ভাষ্যে গ্যালারি কায়ার পরিচালক শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী বললেন, এই প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হকের শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটল।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি বললেন, সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে কোনো বিভাজন নেই। একটা সময় বিখ্যাত কবিরা ছবি এঁকেছেন, আবার চিত্রকর বা ভাস্করেরা কবিতা, নাটক, উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো লেখালেখি করেছেন। আলেস্কান্দর পুশকিন, মায়াকোভস্কি থেকে এলেন গিন্সবার্গসহ অনেকে ছবি এঁকেছেন। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো লেখা ও চিত্রকলা উভয় ক্ষেত্রেই খ্যাতনামা। আনিসুল হক চিত্রকলায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁর আঁকা প্রতিকৃতিগুলোতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিগুলোতে ব্যক্তির অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, একটা সময় তিনি নিজেও আঁকার চর্চা করেছেন। তবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। আনিসুল হক আঁকার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায়ে রাখতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক বিশিষ্ট শিল্পী হাশেম খান বলেন, যাঁরা ছবি আঁকেন, কেবল তাঁরাই শিল্পী নন, সৃজন ও মননশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সবাই শিল্পী। চিত্রশিল্পী হতে হলে এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক নয়। পৃথিবীর বহু কালজয়ী শিল্পী রয়েছেন, যাঁদের শিল্পকলার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। কবি ও কথাশিল্পী আনিসুল হক একজন সংবেদনশীল মানুষ। তিনি চারুকলার চর্চার ভেতর দিয়ে সেই সংবেদনশীলতার সঙ্গে মানবিকতার সংযোগে একটি উদারসহিষ্ণু মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
বিশেষ অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আনিসুল হক বহুগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। নতুন করে তাঁর শিল্পপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেল এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। গুণীজনের প্রতি সম্মান ও তাঁদের স্মরণের জন্য গুণীজনদের নামে উত্তর সিটির বিভিন্ন সড়কের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একটি সড়কের নাম কবি নির্মলেন্দু গুণের নামেও নামকরণ করা হবে বলে তিনি জানান।
মেয়র বলেন, মহানগরকে দৃষ্টিনন্দন করতে উড়ালসড়কের স্তম্ভ ও পাশে চিত্রকলা আঁকার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মগবাজার ও মহাখালী এলাকায় অঙ্কনের কাজ শুরু হয়েছে। এসব স্থানে পোস্টার সাঁটানো থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রদর্শনীতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও অভিনয়শিল্পী নুসরাত ইমরোজ তিশা দম্পতির। তবে ফারুকী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁরা আসতে পারেননি। আনিসুল হক তাঁর বক্তব্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আরোগ্য কামনা করেন।
চিত্রকর্ম সম্পর্কে আনিসুল হক বলেন, নিয়ম করে ছবি আঁকা শেখেননি। শৈশবে বাড়িতে পুঁইবিচি ও নানা ফুলের নির্যাস থেকে রং তৈরি করে কিছু আঁকাজোকার চেষ্টা করেছেন। ঢাকার নিউমার্কেট থেকে রংতুলি কিনে আঁকা শুরু করেছেন কয়েক বছর ধরে। তিনি বলেন, ছবি আঁকা অনেকটাই ধ্যানের মতো। আঁকার সময় এমন নিমগ্নতা এসে যায় জগৎ এমনকি নিজেকেও ভুলে থাকা যায়। বয়সকালের এসব আঁকাকে তিনি বলেছেন ‘ছেলেমানুষি’।
শিল্পী আনিসুল হক তাঁর আঁকা সম্পর্কে যা–ই বলুন দর্শকেরা অবশ্য বেশ আনন্দ পাবেন ছবিতে চোখ রেখে। সেখানে তাঁদের অনেক প্রিয় ব্যক্তিত্বের মুখাবয়ব যেমন দেখতে পাবেন, তেমনি পাবেন বৃষ্টিভেজা শহর, গ্রামীণ দিগন্তে সূর্যাস্ত, নদীর বাঁকে নৌকার সারি, নীলাকাশের পটভূমিতে উড়ে চলা বলাকার ঝাঁকের দৃশ্য। আরও আছে সড়কের পাশে রিকশা থামিয়ে ক্লান্ত চালকের শুয়ে থাকা। শহুরে বাড়ির বারান্দার বাগান, ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া মেঠোপথ—এমন অনেক সুন্দর দৃশ্যপট রচনা করেছেন একদা সুন্দরের কাছে খোলাচিঠি লেখার এই কবি। প্রদর্শনীতে জলরং, মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিক, চারকোল ও কালিকলমের অঙ্কনের প্রায় ৯০টি চিত্রকর্ম রয়েছে। প্রদর্শনী চলবে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সবার জন্য দরজা খোলা বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।