রোজায় মুসলিমদের অনুষ্ঠানে গিয়ে যা বলেছিলেন ম্যান্ডেলা

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুদিবস আজ ৫ ডিসেম্বর। ১১ বছর আগে এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই মহান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা। তাঁর লেখা কনভারসেশন উইথ মাইসেল্‌ফ অবলম্বনে প্রথম আলোর ২০১৩ সালের ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ‘নেলসন ম্যান্ডেল: ঐ মহামানব আসে’ শিরোনামে লেখাটি। এই লেখার ভূমিকা ও নির্বাচনে ছিলেন মতিউর রহমান। অনুবাদ করেছেন রামেন্দ্র চৌধুরী। তাঁর স্মরণে আজ লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে তিন কিস্তিতে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। এখন দেওয়া হল তৃতীয় ও শেষ কিস্তি 

নেলসন ম্যান্ডেলারয়টার্স

দুই মেয়েকে

আমাদের প্রিয়তম মাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মা আর বাবা দুজনই এখন কারারুদ্ধ। এ কথা ভাবলে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় যে, সে এখন বাড়ি থেকে অনেক দূরের কোনো পুলিশ সেলে বসে আছে, সম্ভবত নিঃসঙ্গ এবং কথা বলার মতো কেউ সেখানে নেই, হয়তো পড়বার মতোও কিছুই নেই। দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই তিনি তাঁর ছোট ছোট সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় কাটাচ্ছেন। হয়তো অনেকগুলো মাস বা অনেক বছর পর তোমরা আবার তাকে দেখতে পাবে। তত দিন তোমাদের এতিমের মতোই নিজের বাড়িঘর ও বাবা-মা ছাড়া কাটাতে হবে।

তোমাদের মা যেমনটা দিতে পারতেন, তেমন প্রকৃত ভালোবাসা, স্নেহ ও নিরাপত্তা পাবে না। তোমাদের জন্য এখন আর কোনো জন্মদিন বা বড়দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে না। কোনো উপহার নয়, নতুন পোশাক নয়, জুতা বা খেলনাও নয়। সেসব দিন চলে গেছে, যখন তোমরা বিকেলে উষ্ণ স্নান সেরে মায়ের সঙ্গে টেবিলে বসে তাঁর রান্না করা সরস ও সাধারণ খাবারগুলো উপভোগ করতে। আরামদায়ক বিছানাগুলোও থাকবে না—উষ্ণ কম্বল আর পরিচ্ছন্ন চাদর বিছিয়ে তিনি তোমাদের জন্য যেমনটি করে দিতেন। এখন আর মা তোমাদের বন্ধুবান্ধব ডেকে সিনেমায় বা গানের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে পারবেন না। বিকেলে সুন্দর সুন্দর গল্পও বলতে পারবেন না। কঠিন বই পড়তে তোমাদের সাহাঘ্য করা বা তোমাদের পছন্দমতো অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও সম্ভব হবে না। তোমরা যখন বড় হয়ে উঠছ, যখন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তখন তিনি আর তোমাদের সাহায্য করতে বা সঠিক পথ দেখাতে পারবেন না। হয়তো পশ্চিম ওরল্যান্ডোর ৮১১৫ নম্বর বাড়িটিতে—যা আমাদের সবার হৃদয়ে একান্ত প্রিয়—সেখানে মা-বাবা আর কখনো তোমাদের সঙ্গে একত্র হতে পারবেন না।

মায়ের জেলে যাওয়া তো এবারই প্রথম নয়। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে, আমাদের বিবাহের মাত্র চার মাস পরই আরও ২ হাজার নারীর সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা তখন জোহানেসবার্গ শহরে ‘পাস’ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সেবার তাঁকে দুই সপ্তাহ জেলে থাকতে হয়েছিল। গত বছরও তিনি চার দিন আটক ছিলেন। এবার আবার জেলে যেতে হলো। আমি তোমাদের বলতে পারব না, কত দিন তাঁকে বাড়ির বাইরে আটক থাকতে হবে। আমি আশা করি, তোমরা সব সময় এ কথাটি মনে রাখবে যে, তোমাদের মা একজন সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ মানুষ। তিনি সমগ্র হৃদয় দিয়ে মানুষকে ভালোবাসেন। দেশ ও জনগণের জন্য গভীর ভালোবাসার কারণেই তিনি সুখ ও আরামের জীবনের বদলে একান্ত কষ্টসাধ্য দুঃখের জীবন বরণ করে নিয়েছেন।

তোমরা যখন বড় হয়ে উঠবে, তখন গভীরভাবে ভেবে দেখো, কী নিদারুণ দুর্ভোগের মধ্যে তাঁকে দিন কাটাতে হচ্ছে। আর কতটা দৃঢ়ভাবে তিনি তাঁর বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে তাঁর অবদানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তখনই তোমরা বুঝতে পারবে। তিনি নিজের স্বার্থ বা সুখের চিন্তা না করে কী বিপুল ত্যাগ স্বীকার করছেন, সেটিও তোমরা তখন উপলব্ধি করতে পারবে।...

এত দিন পর্যন্ত তোমাদের মা একটা বেদনাভরা জীবন কাটিয়েছেন। তিনি সব সময় নিয়মিত আয়-উপার্জনহীন একটি পরিবারকে টেনে বেড়িয়েছেন। তবু তিনি কোনো না কোনো উপায়ে তোমাদের জন্য খাদ্য ও পোশাক কিনেছেন, তোমাদের স্কুলের বেতন দিয়েছেন, বাড়িভাড়া মিটিয়েছেন আর আমাকেও নিয়মিত টাকাপয়সা পাঠিয়েছেন।

আমি ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। জেনির বয়স তখন দুই বছর আর জিন্দজি মাত্র তিন মাসের। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমি আফ্রিকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। দশ দিনের জন্য লন্ডনেও গিয়েছিলাম। সে বছরই জুলাই মাসে আমি দেশে ফিরে আসি। তোমাদের মায়ের সঙ্গে দেখা হতেই আমি ভীষণ আঁতকে উঠেছিলাম। যখন বাড়ি ছেড়ে যাই, তখন তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল—শরীর পুষ্ট, বর্ণে উজ্জ্বলতা। কিন্তু হঠাৎই তাঁর ওজন কমে গেছে, আসলে আগের তুলনায় তিনি তাঁর নিজেরই ছায়া মাত্র।

সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার অনুপস্থিতি তাঁকে কী দুঃসহ ক্লান্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। আমি কোন কোন দেশ ভ্রমণ করেছি, কাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে-এসব কথা বলতে শুরু করার আগে আমাকে বেশ কিছুটা সময় নিতে হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট আবার আমাকে গ্রেপ্তার করায় সে স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৮ সালে মা যখন গ্রেপ্তার হলেন, তখন আমি প্রতিদিনই খাবার ও ফল ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম।

আমি যখন বন্দী, তখন এক সাক্ষাতের সময় তোমাদের মা বলেছিলেন, যদিও তাঁর ধারণা, যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে—যেমনটি স্বাধীনতার সংগ্রামে রত সব রাজনীতিবিদই ভাবেন—তবু তিনি দেশে থেকেই তাঁর জনগণের সব দুর্ভোগের অংশভাগী হবেন। এখন কি উপলব্ধি করতে পারছ, কেমন বিপুল সাহসী মা তোমাদের?

 যথাক্রমে ৯ ও ১০ বছর বয়সী দুই মেয়ে জেনি ও জিন্দজি ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি

অন্য গ্রাশা

গ্রাশা ম্যাশেলের সঙ্গে জোহানেসবার্গে অনন্ত তিনবার আমার দেখা হয়েছে। তিনি সময় বিনয়ী, বিচক্ষণ ও সহমর্মী ছিলেন। কিন্তু মাপুতোতে—যেখানে তিনি ১৪ বছর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন এবং এখনো সংসদ সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন—একেবারে আলাদা এক গ্রাশার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। যেখানে তাঁকে মনে হতো দৃঢ় ও কতৃ‌র্ত্বশীল, একই সঙ্গে সৌজন্যপরায়ণ ও মধুর।

প্রেসিডেন্ট শিসানোর জন্য আমি আমার হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধা লালন করি।

 ম্যান্ডেলার নোটবই থেকে

 নেতার দুই ধরন

নেতা দেখা যায় দু রকমের:

১. তাঁরা অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন, তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে পূর্বধারণা করা যায় না। তাঁরা একটি বিষয়ে আজ সম্মতি জানিয়ে কালই অসম্মতি প্রকাশ করতে পারেন।

২. তাঁরা সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন, অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাঁরা স্বপ্নদ্রষ্টাও।

ম্যান্ডেলার নোটবই থেকে

ভবিষ্যতের স্বপ্ন

ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাণ করাই নেতার প্রথম কাজ।

দ্বিতীয় কাজটি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহায়ক কর্মীদল গঠন করা, যারা কার্যকরভাবে নেতার নির্দেশমতো ব্যবস্থা নেবে। নেতাকে অনুসরণকারী কর্মীদের ভবিষ্যতের লক্ষ্য সম্পর্কেও জানতে হবে। কারণ, নেতা সেই স্বপ্ন বা লক্ষ্যকে অনুসরণকারীদের প্রাণে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটিও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

ম্যান্ডেলার নোটবই থেকে 

দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডিক্লার্ক ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ম্যান্ডেলা। ১৯৯৩ সালের ৪ জুলাই
রয়টার্স

প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেক অনুষ্ঠানে ভাষণ

আজ, আমরা সকলে এখানে, দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং বিশ্বের নানা জায়গায় সমবেত হয়ে আমাদের স্বাধীনতার গৌরব ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। সুদীর্ঘকাল আমরা যে অস্বাভাবিক মানবিক দুর্যোগের পথ পেরিয়ে এসেছি, তার অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই বিশ্বমানবতার জন্য গৌরবময় একটা সমাজ বিকশিত হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের দৈনন্দিন কাজে দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বাস্তব রূপটি প্রতিফলিত হোক, যাতে ন্যায়বিচার সম্পর্কে মানবিক বিশ্বাস শক্তিশালী হতে পারে, মানবিক আত্মার মহামনস্বিতার প্রতি সবার আস্থা দৃঢ়তর হয় এবং সবার গৌরবময় জীবনের জন্য আমাদের প্রত্যাশা স্থায়িত্ব লাভ করে। আমরা নিজেদের কাছে এবং এখানে সমবেত প্রতিনিধিত্বশীল সবার কাছে আজ এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।

আমার সংগ্রামী সহযোদ্ধাদের প্রতি আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি, আমরা প্রত্যেকে এই সুন্দর দেশটির মাটিকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে আছি—মাটি কামড়ে ধরে যেমনটি বেঁচে আছে প্রিটোরিয়ার বিখ্যাত জ্যাকারান্ডা আর গুল্মময় প্রান্তরজুড়ে সুগন্ধ হলুদ ফুলের মাইমোসা বৃক্ষ। যতবার আমরা দেশের মাটি স্পর্শ করি, ততবারই আমরা ব্যক্তিগতভাবে নবীনতা প্রাপ্ত হই। ঋতুচক্রের সঙ্গে সঙ্গে জাতির মানসিক অবস্থাও বদলে যায়। তৃণরাজি যখন সবুজাভ হয়ে ওঠে এবং ফুল ফোটে, তখন আমরাও আনন্দে উৎফুল্ল হই।

আমরা প্রত্যেকেই দেশমাতৃকার সঙ্গে আত্মিক ও শারীরিক অবিচ্ছিন্নতা অনুভব করি। এ অনুভূতির মধ্যেই ব্যাখ্যা মেলে—বিশ্বের মানুষ যখন আমাদের দেশটিকে প্রত্যাখ্যান করছিল, অপরাধী বিবেচনা করে নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছিল আমাদের—কী দারুণ বেদনা আমরা বহন করেছি। সংক্ষেপে বলা চলে, আমাদের দেশটিকে যেন ধ্বংসাত্মক নীতি এবং জাতিবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষী নির্যাতনের বৈশ্বিক ভিত্তি করে তোলা হয়েছিল।

আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ আজ পরিপূর্ণ হৃদয়ে উপলব্ধি করছি যে, বিশ্বমানবতা আমাদের আবার বুকে ঠাঁই দিয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেও আমরা যারা অপরাধী ছিলাম, তারাই আজ এক বিরল সুযোগ পেয়েছি, আমাদের মাটিতে বিশ্বের জাতিগুলোর আতিথ্য করতে পারছি। আমরা আমাদের সম্মানিত প্রত্যেক আন্তর্জাতিক অতিথিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, তাঁরাও এখানে সমবেত হয়ে আমাদের জনগণের সঙ্গে ন্যায়বিচার, শান্তি ও মানবিক মর্যাদার এক অসাধারণ বিজয়ে সমভাগী হয়েছেন। আমরা প্রত্যাশা করি, যখন শান্তি ও উন্নতির পথে নরনারীর বৈষম্যহীন, জাতিবৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বিকাশের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করব, তখনো আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন।

আজকের এ অবস্থানে উপনীত হওয়ার সংগ্রামে আমাদের জনগণ এবং তাদের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মীয়, নারী, যুবসমাজ, ব্যবসায়ী, প্রথাগত ও অপরাপর অংশ যে বিপুল ভূমিকা পালন করেছে—গভীর প্রশংসার সঙ্গে আমি তার উল্লেখ করছি। তাঁদের পাশাপাশি আমার পরবর্তী ব্যক্তি, মাননীয় ডেপুটি প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের অবদানও কম উল্লেখযোগ্য নয়।

সেনাবাহিনী এবং সব স্তরের সেনা সদস্যদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমাদের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এবং অন্ধকারের রক্তপিপাসুরা, যারা এখনো আলোতে আসতে রাজি নয়, তাদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের কাজেও তাঁরা অপরিসীম সহযোগিতা প্রদান করেছেন।

দুঃখ-দুর্যোগের ক্ষত আরোগ্যের সময় এখন সমাগত। যে গভীর ফাটল আমাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছিল, তাতে সেতুবন্ধ স্থাপনের মুহূর্ত এসে গেছে। পুনর্গঠনের সময়টি আমাদেরই হাতে। অবশেষে আমাদের রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তি ঘটেছে। আমরা আমাদের জনগণকে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, দুর্দশা লৈঙ্গিক এবং অন্যান্য বৈষম্য থেকে মুক্তির অঙ্গীকার করছি।

তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পন্থায় আমরা স্বাধীনতার শেষ পদক্ষেপটি নিতে পেরেছি। আমরা পূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও স্থায়ি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। আমাদের লাখ লাখ মানুষের বুকে আশা সঞ্চারের সংগ্রামে আমরা বিজয়ী হয়েছি। এখন আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছি যে, আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলব, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ—কালো বা সাদা—সবাই নির্ভয়ে মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারবে। সবাইকেই অসমর্পণীয় মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। আমাদের বহুবর্ণ জাতি নিজেদের মধ্যে এবং বিশ্বে শান্তিতে থাকবে।

জাতীয় ঐক্যের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার জাতির পূণর্নবীকরণের অঙ্গীকারের নিদর্শনস্বরূপ, জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে, আমাদের জাতির যেসব মানুষ বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করছেন, তাদের সবার প্রতি ক্ষমা ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া করবে।

এ দেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যত বীর ও বীরাঙ্গনাবৃন্দ আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে জীবনদান করেছেন, আজকের দিনটিকে আমরা তাঁদের সবার প্রতি উৎসর্গ করছি। তাঁদের স্বপ্ন সত্য হয়েছে। স্বাধীনতাই তাঁদের পুরস্কার।

দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক, জাতবৈষম্যমুক্ত ও নরনারীর বৈষম্যহীন জাতি গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করায় আমরা একই সঙ্গে বিনম্র ও সম্মানিত বোধ করছি। আমরা এখনো উপলব্ধি করি যে, স্বাধীনতার কোনো সহজ পথ নেই। আমরা ভালো করেই জানি যে, আমরা কেউই একাকী কোনো সফলতা অর্জন করতে পারব না। জাতীয় পুনর্মিলন, জাতিগঠন এবং একটা নতুন বিশ্বব্যবস্থা সূচনার লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে সম্মিলিত জনগণ হিসেবে কাজ করতে হবে।

 সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত হোক। সবার জীবনে নিশ্চিত শান্তি আসুক। সবার জন্যই কাজ, খাদ্য, পানি ও লবণের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হোক। প্রত্যেকে জেনে রাখুন, আপনাদের নিজ নিজ পূর্ণতার লক্ষ্যে প্রত্যেকের দেহ, মন ও আত্মার মুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। না, আর নয়, আর কখনো আমাদের এ সুন্দর দেশের মানুষ একের দ্বারা অপরে নির্যাতিত হবে না, বিশ্বে নোংরা মানুষ হিসেবে অসম্মানিত হবে না। স্বাধীনতাই শাসন করবে। এমন একটি গৌরবময় অর্জন কখনো আঁধারে হারিয়ে যাবে না।

ঈশ্বর আফ্রিকার কল্যাণ করুন।

 ইউনিয়ন বিল্ডিং, প্রিটোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ১০ মে ১৯৯৪

আরও পড়ুন

মুসলিম নবজীবন

যাঁরা গত এক মাসজুড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করেছেন, সেই সমাজের সবার প্রতি বুকভরা প্রশংসা নিয়ে আজ আমি এখানে এসেছি। রমজানের ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে, ব্যক্তিজীবনে শৃঙ্খলা সূচিত হয়, অনাহারি মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা যায় এবং চেতনা নবায়নেরও সুযোগ পাওয়া যায়।

 রমজানের ত্যাগ থেকে শাইখ মাতুরার মতো মানুষের বিশালতাও উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। আমাদের দেশজুড়ে যখন চরম অন্ধকারের রাজত্ব, তখন রোবেন দ্বীপে বন্দিজীবন কাটানোর সময় আমরা তাঁর দরগাহ্‌ থেকে গভীর অনুপ্রেরণা ও আত্মিক শক্তি লাভ করতাম।

 সে সময় দরগাহ্‌র মাধ্যমে ইসলামের সঙ্গে সংযোগ এবং ইমাম বশিরের পরিভ্রমণকালে কিছুটা আনন্দ উপভোগেরও সুযোগ পাওয়া যেত। আমরা লক্ষ করেছিলাম, যে বন্দী দরগাহ্‌ পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত হতো, সে বেশ তাড়াতাড়ি সুপুষ্ট হয়ে উঠত; যদিও সাধারণ বন্দীদের ওজন কমে যেত। পরে অবশ্য আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে দর্শনার্থীদের রেখে যাওয়া বিরিয়ানি আর সমুচা খেয়েই তারা মোটাসোটা হয়ে যেত।

 শাইখ মাতুরার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে ইসলামের গভীর শেকড় বিস্তারেরও পরিচয় পাওয়া যায়। এমন পরিচয় মেলে তাঁদের মধ্যেও, যাদের রাজনৈতিক নির্বাসনে এ অন্তরীপে পাঠানো হয়েছিল, বা ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল। শাইখ ইউসুফের নামটিও প্রথমে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম নেতা। তাঁদের অনেককেই চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে ভারত ও জাঞ্জিবার থেকে নাটালের ইক্ষুখামারে কাজ করানোর জন্য আমাদের পূর্ব উপকূলে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের আরও অনেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভূদৃশ্যে অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যান্ডেলার শপথ নেওয়ার সময় হাজার হাজার সমর্থক সিটি হলের সামনে জড়ো হয়ে উল্লাস করেন। ১৯৯৪ সালের ৯ মে
ছবি: রয়টার্স

 আমাদের দেশ গর্বের সঙ্গেই মুসলমানদের ভাইবোন বলতে পারে, বলতে পারে মুক্তিযোদ্ধা ও নেতা। তাঁরা আমাদের জাতির গভীর শ্রদ্ধাভাজন। সম্মান-তালিকায় রক্ত, ঘাম ও চোখের জলে তাঁরা নিজেদের নাম লিখে গেছেন।

 আমরা যখন আজ ঈদের দিনটি উদ্‌যাপন করছি, রমজানের উপকার অনুভব করছি, আলোচনা করছি কীভাবে ইসলাম আমাদের জাতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং বিনিময়ে কীভাবে আমাদের জাতি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আপন বলে বুকে টেনে নিয়েছে—তখনো এই ভেবে আমরা দুঃখবোধ করি যে, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারকে কী করে আফ্রিকায় ও অন্যত্র উত্তেজনা ছড়ানোর কাজে লাগানো হচ্ছে। প্রায়শই এভাবে ধর্মের অপব্যবহার করা হলেও এ সত্য অনস্বীকার্য যে, মানুষকে একতাবদ্ধ করা ও অপরের প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টির ব্যাপারে ধর্মের প্রভূত শক্তি রয়েছে। আমার বিশ্বাস, মুসলমানেরা নিজেদের অন্তর্গত ঐতিহ্যের শক্তি দিয়ে আফ্রিকায় অধিকতর মানবিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অবদান রাখতে পারেন।

 আবিসিনিয়ার খ্রিষ্টান রাজা নেগাস যখন নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীদের সুরক্ষা দিয়েছিলেন, তখন থেকেই আফ্রিকা ইসলামকে আপন করে নিয়েছে। পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার এ উদাহরণ থেকেই উপলব্ধি করা যায়, আমাদের মহাদেশকে নবজীবনে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে ধর্ম কী ভূমিকা পালন করতে পারে, আধ্যাত্মিক নেতারা কী বিপুল অবদান রাখতে পারেন।

 দক্ষিণ আফ্রিকা এখন মুক্ত ও স্বাধীন। আমাদের মহাদেশের অন্যান্য অংশে ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যে সংযোগ-সম্পর্ক রয়েছে, তা আমাদের দেশেও অবিকৃতভাবে বিকশিত হতে এবং আমাদের জাতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাঁরা আফ্রিকায় আমাদের সাধারণ ঐতিহ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 বর্ণবিদ্বেষের বছরগুলোয় মুসলমানেরা আমাদের আহ্বানে নির্যাতনবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। এখানে, এই জোহানেসবার্গ অঞ্চলেই আমরা ‘গোষ্ঠীভিত্তিক আঞ্চলিক আইন’-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত হতে দেখেছি, যা আমাদের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

 আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীসমূহের সহায়তায় আমরা সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছি, আর তা দক্ষিণ আফ্রিকার সবাইকে স্বশাসনের অধিকার দিয়েছে। আমরা এমন সংবিধান কার্যকর করেছি, যেখানে সব ধর্মের সমতা ও পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

 আমরা এখন এক নতুন ও কঠিনতর সংগ্রামের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছরে, জাতি হিসেবে আমরা ভালোভাবেই যাত্রা শুরু করতে পেরেছি। তবে আমাদের সব গোষ্ঠীর প্রতেকে জানি যে, আরও বহু কিছুই করার বাকি রয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে, আমাদের প্রত্যেককেই নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে: আমরা কি আমাদের স্বপ্নের দেশটিকে গড়ে তোলার জন্য সাধ্যমতো সবকিছু করছি, কর্মসৃজন ও উন্নতি অব্যাহত রাখার জন্য সব সুযোগ কি কাজে লাগাতে পারছি? আইন মান্যকারী নাগরিক হিসেবে আমরা কি নিশ্চিত করতে পেরেছি যে, অপরাধীরা আমাদের মধ্যে আশ্রয় পাবে না? যে এলাকায় আমরা বসবাস করি, তার উন্নয়নে আমরা কি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছি?

 জনগণের ওপর যে বিভেদ-বিরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আমি জানি, তার অবসানের লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলিম সংগঠনগুলো নিজেদের মহার্ঘ্য মানবিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে। আমাদের ইতিহাসে জাতিবিদ্বেষের সুদীর্ঘ সময়কালে সামাজিক সম্পর্কের সূত্রগুলো ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেসব ক্ষত সারিয়ে তোলার কাজে নিজেদের উদ্যোগ অব্যাহত রেখেই মুসলিম সংগঠনগুলো সফলতা লাভ করতে পারে।

 আমি নিশ্চিত যে, আজকের ঈদ উদ্‌যাপন ও রমজানের অনুপ্রেরণা আমাদের সেই মূল্যবোধ ফিরে পেতে সহায়তা করবে, আরবি ভাষায় যাকে বলা হয় সুমুদ বা অবিনশ্বর আদর্শিক শক্তি, যা সবার জন্য উন্নততর জীবনের নিশ্চয়তা দেয়, বিশেষভাবে নিশ্চিত করে দরিদ্রদের উন্নয়ন।

 আপনাদের হৃদয় ও মনের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টায় আপনারা সতত স্রষ্টার করুণা উপলব্ধি করুন। আজকের এ ঈদের দিনে আপনারা মানবিক সেবার যে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন, তার জবাব প্রতিফলিত হোক আপনাদের ও অপরাপর সবার ভেতরেই।

আন্তসাংস্কৃতিক ঈদ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ

আরও পড়ুন

ডেসমন্ড টুটুকে ধন্যবাদ

 কেপটাউনের আর্চবিশপের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে আমি যথার্থই সম্মানিত বোধ করছি। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার এ প্রদেশটিরও আর্চবিশপ এবং তিনি মাত্র সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর ৬৫তম জন্মদিনের প্রাক্কালে অবসর নিতে যাচ্ছেন। ধারণা করি, আমার আগেই অবসর গ্রহণ করে তিনি একটি নজির স্থাপন করছেন।

এখানে সমবেত সবার পক্ষ থেকে আমি বলতে পারি, আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, তাঁর ধর্মোপদেশমূলক মন্ত্রণা, ক্ষমাশীল কার্যাবলি, প্রেরিত-পুরুষসুলভ প্রত্যয়ন ও রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অসংখ্য মানুষের কাছে আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। গির্জার নেতা ও সমগ্র খ্িরষ্টজগতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সম্মানজনক রেকর্ডের অধিকারী। তা ছাড়া, অমানবিক ও দুরাচারী বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি একজন নির্ভয় যোদ্ধা হিসেবেও সুপরিচিত। দরিদ্র, নির্যাতিত ও পশ্চাৎপদদের প্রতি নিঃস্বার্থ অঙ্গীকারের জন্যও তিনি সুপরিচিত। যখন গির্জার অনেক ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকেই বন্দী করা হতো, নির্বাসনে পাঠানো হতো, নিষিদ্ধ বা কর্মক্ষেত্র সংকুচিত করা হতো, সেই পরিস্থিতিতে তিনি নিজের সহকর্মীদের নিয়ে এক কার্যকর প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।

 ডেসমন্ড টুটু সর্বক্ষেত্রেই সুবিচার ও শান্তির প্রতি আপসহীন অঙ্গীকারের জন্য বিশ্বজোড়া সম্মানের অধিকারী। দুর্নীতির নিন্দা তিনি সোজাসুজি করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে—তা সেটি আফ্রিকা মহাদেশেই হোক বা অন্যত্র—প্রতিবাদ করার সব সুযোগ তিনি কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর কর্মতৎপরতার ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃৃতির সঙ্গে একান্ত সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

 তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে অজনপ্রিয় অবস্থান গ্রহণের সাহস দেখাতে পারেন। দক্ষিণ আফ্রিকার গির্জাগুলো যখন গভীর সংশয়ে ছিল, তেমন এক সময়েই আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বর্ণবাদবিরোধী প্রচার শুরু করেছিলেন। জনগণের নৈতিকতার প্রসঙ্গে তিনি মন খুলে কথা বলতে পারেন। আর এ কারণেই বর্ণবাদী ব্যবস্থার অনেক নেতাই তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। বর্ণবাদী নেতাদের অনুসারীদেরও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। অনেক সময় তিনি আমাদের মতো নতুন পথের অনুসারী অনেককেও ক্রোধান্বিত করেছেন। কিন্তু অনস্বীকার্য যে, এ রকম স্বাধীন মানসিকতা, যদিও অনেক সময় কৌশলহীন বলেই মনে হয়, তথাপি গণতন্ত্র বিকাশের জন্য একান্তই অপরিহার্য।

 আমি তাই আজকের অনুষ্ঠানে সুযোগ গ্রহণ করে, স্বাধীনতা ও সুবিচারের সংগ্রামে তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য আর্চবিশপকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথে আপনার সাহচর্য, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়সনির্বিশেষে আমাদের জনগণকে জীবন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মানবোধে অনুপ্রাণিত করেছে।

 নতুন সংবিধানে আমাদের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়ে ন্যায়পরায়ণ, জাতিগত বিদ্বেষহীন এবং লিঙ্গবৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজবিকাশের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে উল্লিখিত এ দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন করার বিষয়টি আমাদের সবাইকেই এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যত দিন পর্যন্ত আমাদের জনগণের অনেকে নিদারুণ দারিদ্রে্যর মধ্যে বাস করবে, শিশুদের প্লাস্টিকের আবরণের নিচে থাকতে হবে, অনেক মানুষই কর্মহীন থাকবে, তত দিন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো মানুষের পক্ষেই বিশ্রাম বা স্বাধীনতার আনন্দে গা ভাসিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

 দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজ থেকে বর্ণবৈষম্যবাদী ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট বৈষম্য ও অসাম্য যতটা দূর করা সম্ভব হবে, দক্ষিণ অফিকাকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের পরশপাথর ততটাই আমাদের করায়ত্ত হবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষার মূল দিকটি নিহিত রয়েছে মোটা দাগের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, কর্মসংস্থান ও পুনর্বণ্টন ইত্যাদি কৌশলগত নানা ক্ষেত্রে। এটাই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির একটি নির্মাণকাঠামো, যেখানে সবাই হাত মেলাতে পারেন এবং স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যের বদলে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে বড় করে দেখেই আমাদের পক্ষে পরিবর্তন, পুনর্গঠন ও উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা সম্ভব হতে পারে।

 এমন বিপুল অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও বিদেশের গির্জাগুলো আমাদের যেভাবে স্বাধীনতা ও শান্তি অর্জনের সংগ্রামে সহায়তা দিয়েছে, এখনো তাদেরকেই আবার ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের সহযাত্রী হতে হবে।

 ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সরকারের প্রতি সমালোচনাহীন সমর্থন জানানোর জন্য আহ্বান করা হচ্ছে না। সমালোচনাহীন সমর্থন বরং আমাদের শিশু-গণতন্ত্রের জন্য বিপদেরই কারণ হতে পারে। অন্যদিকে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের উদ্যোগহীন নিষ্ক্রিয় সমালোচনা কেবল গির্জার বক্তব্যকে কৃতিত্বহীন বলেই প্রমাণ করতে পারবে। অপরদিকে, কোনো কোনো ধর্মীয় নেতা যাকে বলেন ‘সমালোচনাপূর্ণ সংহতি’, সরকারের সঙ্গে এমন সম্পর্ক স্থাপন করেই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারে।

 দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে-পরে, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর অবদানের যে ধারাবাহিকতার কথা আমাদের জানা রয়েছে, তাতে আমরা নিশ্চয়ই আস্থাশীল হতে পারি যে, তারা স্বাধীন পরিবেশে জনগণের ক্ষমতায়ন ও জীবন-মান উন্নয়নের প্রকল্পসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের কৌশলগত সহযোগী হতে পারে। আমাদের নতুন জাতিগঠনের লক্ষ্যে পুনর্গঠন ও সামঞ্জস্যবিধান বা পুনর্মিত্রতা প্রতিষ্ঠার কাজগুলো পাশাপাশিই চালাতে হবে। গির্জাগুলোর দিকে আমরা এমন প্রত্যাশার চোখেই তাকিয়ে থাকব যে, তাঁদের বার্তাসমূহই মূল সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে, যাতে সব বর্ণের মানুষই ন্যায়, শান্তি, ক্ষমা ও পুরোনো ক্ষত উপশমের মাধ্যমে বিভেদ-বিভাজন কাটিয়ে উঠে আগের ভুলগুলো সংশোধন করে ন্যায়সম্মত শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।

আর্চবিশপ টুটু, রংধনুর মতো আমাদের বহুবর্ণ সমাজের আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন এবং তাঁর ‘সত্য ও সামঞ্জস্য বিধানের কমিশন’ (টুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন)-এর শক্তিময় উপশমকারী নির্দেশনার কারণে আমাদের জাতির সামঞ্জস্য বিনির্মাণের জটিল কর্মক্ষেত্রে অফুরাণ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। আমাদের বৈচিত্রে্যর মধ্যে তাঁর আনন্দ ও ক্ষমাশীলতার কথা, আমাদের জাতিগঠনে তাঁর অপরিমেয় অবদানের কথা, ন্যায়পরায়ণতার প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ ও দরিদ্রদের প্রতি তাঁর একাত্মতার কথা সর্বদাই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আমার বক্তব্যের সমাপ্তিতে আমি কি আবার বলতে পারি: আপনার সব অবদানের জন্যই আমরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আপনি তাঁদেরই একজন, যাঁরা আমাদের দেশে দেশপ্রেমের নতুন মশাল প্রজ্বালন করেছেন। আপনার অবসর জীবনের জন্য আমরা শান্তি ও আনন্দের প্রার্থনা করছি।

 ২৩ জুন, ১৯৯৯-এ আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে ভাষণ