দেখতে অনেকটা পিপার মতো। মাটির তৈরি এই সিলিন্ডার দুই হাজার ৬০০ বছরের পুরোনো। পারস্যের (বর্তমান ইরান অঞ্চল) তৎকালীন সম্রাট সাইরাসের নামে নামকরণ: সাইরাস সিলিন্ডার। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটিই বিশ্বের ‘প্রথম মানবাধিকার সনদ’।খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ব্যাবিলন দখল করার পর সাইরাসের নির্দেশে সিলিন্ডারটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে খোদাই করে লেখা আছে পারস্য সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের কথা।যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে সিলিন্ডারটি সম্প্রতি কিছুদিনের জন্য ধার নেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বিভিন্ন শহরে নিদর্শনটি প্রদর্শিত হয়। ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পারস্যের অবদানের কথা নতুন করে আলোচনায় আসে।ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পরিচালক নিল ম্যাকগ্রেগর বলেন, সাইরাস ও দারিউস প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল বলকান অঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত। জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার আদর্শ ওই রাষ্ট্রেই প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি তথ্য অনেককেই বিস্মিত করতে পারে, আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানপ্রণেতারা সাইরাসের সেই আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই বিবেচনায় আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের পথচলায় ইরানের অবদান স্বীকার করতে হয়। অথচ দুটি দেশের বর্তমান সম্পর্ক কতই না বৈরী!ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে সংগৃহীত ১৬টি নিদর্শন প্রদর্শিত হয় ‘সাইরাস সিলিন্ডার অ্যান্ড অ্যানসিয়েন্ট পারসিয়া: অ্যা নিউ বিগিনিং’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে। আর সাইরাস সিলিন্ডারই এ প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ। পিপা আকৃতির সিলিন্ডারটি ব্যাবিলনের ভিত্তিস্তম্ভে ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও কূটনীতিক হরমুজদ র্যাসামের নেতৃত্বে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) থেকে সিলিন্ডারটি ১৮৭৯ সালে উদ্ধার করা হয়।সাইরাস সিলিন্ডারে বর্ণিত রয়েছে সম্রাট সাইরাসের ব্যাবিলন আক্রমণের ইতিহাস। তিনি ব্যাবিলনের দেবতা মারদুকের আমন্ত্রণে প্রথম সেখানে গিয়েছিলেন। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন ব্যাবিলনীয়দের হাতে নির্যাতিত দাস জাতিগোষ্ঠীকে। এ ছাড়া তাদের প্রার্থনালয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাইরাসের নির্দেশেই। মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ইহুদিরাও ছিল। তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন সাইরাস। এসব অসাধারণ পদক্ষেপ বা অবদানের জন্য একজন ‘উদার ও আলোকিত সম্রাটের’ সুনাম অর্জন করেন সাইরাস।
সাইরাসের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে গ্রিক চিন্তাবিদ জেনোফন লিখেছেন সাইরোপিডিয়া। বইটি (গ্রিক ও লাতিন ভাষায়) ইউরোপে ১৭৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। একটি কপি স্থান পেয়েছে ওয়াশিংটন ডিসির বিশেষ প্রত্নপ্রদর্শনীতে। আরেকটি কপি ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের সংগ্রহে, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংরক্ষিত রয়েছে।
সক্রেটিসের সমসাময়িক চিন্তাবিদ জোনোফন লিখেছেন সাইরাস কীভাবে সহিষ্ণুতার ওপর ভিত্তি করে একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ শাসন করতেন। ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের যুগে সাইরোপিডিয়া বা সাইরাসের উদারপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়াপ্রণেতারাও বইটির মাধ্যমে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত সংগ্রহশালা ফ্রিয়ার অ্যান্ড স্যাকলার গ্যালারিসের পরিচালক জুলিয়ান র্যাবি বলেন, মানবিকতার প্রতি ইরানের অনন্য অবদানের বিষয়টি মার্কিনদের সামনে তুলে ধরার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি দেশকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালনার কথা অষ্টাদশ শতকের রাষ্ট্রনায়কেরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশের প্রায় ১০০ বছর পর সাইরাস সিলিন্ডারটি ভূগর্ভ থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই ঘোষণার খসড়াপ্রণেতা টমাস জেফারসন ও তাঁর সহযোগীরা নির্ভর করেছিলেন জেনোফনের সাইরোপিডিয়ার ওপর। জেফারসন পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সাইরাসের আদর্শ নিবিড়ভাবে পড়েছিলেন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও পড়তে বলেছিলেন। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংগ্রহশালা ফ্রিয়ার অ্যান্ড স্যাকলারের পরিচালক (কিউরেটর) মাসুমেহ ফরহাদ বলেন, জেফারসন তাঁর নাতিকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, গ্রিক ভাষা শেখা শুরু করার পর প্রথমেই সাইরোপিডিয়া পড়া উচিত।
কালের বিবর্তনে সাইরাস সিলিন্ডারটিতে একাধিক ভাঙন দেখা দিয়েছে, তবে এর ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এতটুকু ম্লান হয়নি।
l আশিস আচার্য
সূত্র: বিবিসি অনলাইন