বিএনপি কি একটি রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে, না এটি কেবল আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটি প্রতিক্রিয়া? একটি রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে যে নীতি-পরিকল্পনা ও কর্মসূচি থাকতে হয়, জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে হয়, বিএনপি কি তা অর্জন করতে পেরেছে?
বিএনপির অনুসারী বা সমর্থকেরা বলবেন, শতভাগ পেরেছে। বিরোধীরা বলবেন, পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যে চরম বিপরীত মত রয়েছে, তার সুলুকসন্ধান করতেই মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন বিএনপি: সময়-অসময় বইটি। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি যে বিষয়টি লিখছি তা হলো একটা রাজনৈতিক দলের ইতিবৃত্তি। ‘ইতিহাস’ বলার সাহস আমার নেই।’
মহিউদ্দিন আহমদ বিএনপির ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবৃত্তের ওপর আলোকপাত করেছেন। আলোচনায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টি, যা কখনো একই রাজনৈতিক ধারার বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে প্রকট রূপ নিয়েছে, কখনো রাজনৈতিক-সামরিক শক্তির মধ্যকার বিভাজন বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ বলতে চেয়েছেন, পঁচাত্তরে যা ঘটেছে, তার বীজ উপ্ত ছিল একাত্তরেই। তিনি লিখেছেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সম্প্রতি রাজনৈতিক ইতিহাসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পঁচাত্তরের আগস্টের পরের কয়েক মাসের ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে। আবির্ভূত হয়েছে নতুন কুশীলবের। সেই কুশীলব নিঃসন্দেহে সামরিক বাহিনী থেকে এসেছে।’
লেখক বিএনপির ইতিবৃত্ত বলতে গিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সামরিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশেষ করে ভারত সম্পর্কে সেনাবাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের বৈরী মনোভাব তুলে ধরেছেন। একাত্তরের আগে সাতচল্লিশে একবার এই ভূখণ্ডের মানচিত্র বদল হয়। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হয়ে যায়। তিনি লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’ ও ‘জিন্দাবাদ’ শুধু দুটি রাজনৈতিক দলের স্লোগানে সীমিত থাকেনি, তার মধ্যে উভয় পক্ষ নিজের পরিচয় সত্তা খুঁজে নিতে চেয়েছে।
>
বিএনপি: সময়-অসময়
মহিউদ্দিন আহমদ
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল l প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা l ৩৬৮ পৃষ্ঠা l দাম: ৬০০ টাকা
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমরা দ্বিজাতিতত্ত্বের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারিনি। একাত্তরের সবাই এক উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধও করেননি। কেউ সাতচল্লিশকে নাকচ করতে চেয়েছেন। কেউ সাতচল্লিশ ও একাত্তরের মধ্যে আপসরফা করতে চেয়েছেন। আবার কেউ বা বড় পাকিস্তান ভেঙে ছোট পাকিস্তান করতে সচেষ্ট ছিলেন।
কোনো রাজনৈতিক দলই যে তার ঘোষিত নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে চলে না, রাজনৈতিক পালাবদলের পর দলবেঁধে নেতা-কর্মীদের একদল থেকে আরেক দলে ‘হিজরতই’ তার প্রমাণ। এই হিজরত শুধু সামরিক শাসকের দল বিএনপিতে ঘটেনি। সংগ্রামের মাঠ থেকে উঠে আসা দল আওয়ামী লীগেও এন্তার ঘটেছে। রাজনীতির উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া, তাই যখন তারা যেটি অধিকতর সুবিধাজনক মনে করেছে, সেটি সানন্দে গ্রহণ করেছে। আজ যাঁরা আওয়ামী লীগের মিত্র, পঁচাত্তরের আগে বা পরেও দুই দশকে তাঁদের অনেকেই মিত্র ছিলেন না। সময়ের ব্যবধানে দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহীর সংজ্ঞাও বদলে যায়। কিন্তু বদলায় না সাধারণ মানুষের ভাগ্য।
অন্যান্য সামরিক শাসক যেমন পরিকল্পনা করে ক্ষমতা দখল করেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সেটি করেননি। সামরিক-বেসামরিক যে শক্তির যোগসাজশে ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয়েছে, সেই শক্তিই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তবে জিয়া ৭ নভেম্বর নিজে ক্ষমতা দখল না করলেও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পূর্বসূরি আইয়ুবকেই অনুসরণ করেছেন। প্রথমে তিনি গণভোট দিয়েছেন, তারপর বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে দল ও ফ্রন্ট গঠন করেছেন এবং একক কর্তৃত্বে দল ও দেশ চালিয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়া ততটুকুই গণতন্ত্র দিয়েছেন, যতটুকু তাঁর ক্ষমতাকে নিরাপদ রাখে।
জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিতে যে টালমাটাল অবস্থা চলছিল, তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া দায়িত্ব নেওয়ায় পর তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। আশির দশকে বিএনপি সত্যিকার দল হয়ে ওঠে। তাই ৩৮ বছর বয়সী বিএনপির রাজনীতিকে বিচার করতে হবে ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরের অবস্থা থেকে। বনেদি রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের মতো বিএনপির নেতা-কর্মীরাও জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন। এখনো হচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির আগমন অনিবার্য ছিল কি না, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার সুযোগের সদ্ব্যবহার কোনো বাম দল করতে পারলে হয়তো ডানপন্থী বিএনপি নিজেকে একমাত্র বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত না। কিন্তু বামদের অনুপস্থিতি কিংবা দেউলিয়াত্বের কারণে বিএনপির আগমন ঘটে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যেমন একসময় আওয়ামী লীগকে দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল, তেমনি জাসদ জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে সিপাহি জনতার বিপ্লবের খোয়াব দেখেছিল।
মহিউদ্দিন আহমদ এই বইয়ে কেবল বিএনপির সময়-অসময় বর্ণনা করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতির সময়-অসময়ও বিবৃত করেছেন। অসময় থেকে রাজনীতিকে সময়ে নিয়ে আসার দায়িত্বটি যে রাজনীতিকদেরই, সে কথাটি তাঁরা প্রায়শ ভুলে যান।তাঁরা ভাবেন বিরোধী পক্ষকে কথায় ঘায়েল করতে পারলেই বড় দেশপ্রেমিক হওয়া যায়। কিন্তু তাঁরা পূর্বসূরির চেয়ে উন্নত কোনো শাসন উপহার দিতে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
কেবল বিএনপি নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতর-বাহির জানতে বইটি যেকোনো অনুসন্ধানী পাঠককে আন্দোলিত করবে। চিন্তার খোরাক জোগাবে।