শহীদুল জহির জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না, সেটি হওয়ার কোনো ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। বরং নিজেকে দাবি করতেন ‘ডিমান্ডিং লেখক’ হিসেবে; যিনি পাঠকদের কাছে আশা করতেন চিন্তার সক্রিয়তা। জনচিত্ত জয় করার মতো আখ্যান তিনি লিখতেন না; বরং ঘটনাপ্রবাহে, ভাষায়, প্রকরণে, সর্বোপরি নির্মাণশৈলীতে তুলে রাখতেন এক দুর্ভেদ্য দেয়াল। সেই দেয়াল সরিয়ে যারা ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছেন, কেবল তাঁরাই সন্ধান পেয়েছেন প্রচুর মণি-মাণিক্যখচিত এক অচেনা জগতের। রহস্যময় সব গল্প শোনাতেন তিনি আমাদের। রহস্যময়, কারণ, তাঁর গল্প ঠিকঠাক বুঝে ওঠা কঠিন, যদিও অজ্ঞাত কারণে পাঠকেরা সেগুলো পছন্দ করেন। কেন পছন্দ করেন—এই প্রশ্ন বরাবরই তাঁর পাঠকদের জন্য ছিল বিব্রতকর। সত্যি কথা বলতে, আমার জন্যও। আমি নিজেও সব সময় তাঁর লেখা বুঝে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে, তাঁর চরিত্রগুলোর অদ্ভুত-উদ্ভট-রহস্যময় কাণ্ড-কীর্তি একধরনের বিমূঢ় অনুভূতি সৃষ্টি করত আমার মধ্যে, এখনো করে। কী ধরনের রহস্যময়তা থাকত তাঁর আখ্যানে, তার দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
‘ডলু নদীর হাওয়া’ গল্পে তৈমুর আলি চৌধুরী বাধ্য হয়ে একটি শর্ত বা চুক্তি মেনে নিয়ে মগকন্যা সমর্তবানু ওরফে এলাচিংকে বিয়ে করে। চুক্তিটি হলো—সমর্ত তার স্বামীকে ‘জহর’ (বিষ) দিয়ে মারবে। এবং এটি যে কেবল কথার কথা নয়, বরং সে যে সত্যিই কাজটি করতে চায়, সেটি প্রমাণ করে বাসররাতেই। দুটো বিড়ালকে পায়েস খেতে দিলে এর একটি মারা যায় (অর্থাৎ, সেটিতে বিষ মেশানো ছিল), অন্যটি তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। অতঃপর তৈমুর আলিকে বাধ্য হয়েই এই ‘খেলায়’ অংশগ্রহণ করতে হয়। সমর্তবানু তার স্বামীকে প্রতিদিন দুটো গ্লাস এগিয়ে দেয়, যার একটিতে বিষ, আরেকটিতে বিশুদ্ধ পানি। চল্লিশ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই ভয়ংকর ‘খেলা’ চলে এবং তৈমুর আলি নির্ভুলভাবে প্রতিদিনই পানির গ্লাসটি তুলে নেয়। সমর্তবানুর এই আচরণের ব্যাখ্যা কী? সে কি প্রতিশোধ নেয়, যেহেতু এই বিয়েতে সে সম্মত ছিল না, নিতান্তই বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে? তৈমুর আলিই বা কী করে নির্ভুলভাবে প্রতিদিনই পানির গ্লাসটি তুলে নেয়? কেন কখনোই তার হাতে বিষের গ্লাসটি উঠে আসে না? এর ব্যাখ্যাই বা কী? দুটো গ্লাসের একটিতে সত্যিই বিষ ছিল কি না, সেই সন্দেহ তৈমুর আলির মনে যেমন জাগে, জাগে পাঠকের মনেও। কিন্তু একদিন কৌতূহলবশত দুটো গ্লাসের পানিই একসঙ্গে খেয়ে ফেললে তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তার পরও সন্দেহটির অবসান হয় না। কারণ সমর্তবানুর যে হীরার আঙটিটি ছিল, যেটি সে ব্যবহার করত ‘জহর’ তৈরি করার জন্য; সেটি সত্যিই হীরার কি না, নতুন করে সেই প্রশ্নও উঠে আসে। গল্প শেষ হয়ে যায় এসব প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই; কিছুই বুঝে ওঠা যায় না, আবার এড়িয়েও যাওয়া যায় না। তাঁর লেখা পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বইটি আলগোছে সরিয়ে রেখে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার কোনো উপায়ও থাকে না। একটা ব্যাখ্যা হয়তো আমরা খুঁজতে থাকি, হয়তো ভাবতে থাকি—যে তীব্র প্রেম তৈমুর আলিকে ওই মগকন্যার কাছে নিয়ে গিয়েছিল, সেই প্রেমকে দাম্পত্য সম্পর্কে রূপ দেওয়াটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। প্রেম ও দাম্পত্য জীবন তো আসলে প্রায় পরস্পরবিরোধী ব্যাপার, একসঙ্গে যেতেই চায় না। সংসারের নানা খুঁটিনাটি, জটিলতা আর গতানুগতিক-দৈনন্দিন জীবনের অসহ্য পৌনঃপুনিকতার ভেতরে প্রেম কোথায়? এ তো বিশুদ্ধ যন্ত্রণা! কিন্তু শুধু কি যন্ত্রণাই থাকে? আর কিছু নয়? হয়তো থাকে, কিন্তু তা ওই পানির মতোই সাদামাটা—প্রয়োজনীয় কিন্তু বর্ণহীন! এ বিষয়টিকেই হয়তো শহীদুল জহির উপস্থাপন করলেন পানি ও বিষের আদলে। অর্থাৎ, আপনি যদি সংসারজীবনে প্রবেশ করেন, তাহলে প্রতিদিনই আপনাকে অপ্রতিরোধ্যভাবে বিষের মুখোমুখি হতে হবে এবং আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপনি ওই বিষ পান করে মুক্তি লাভ করবেন (গল্পের শেষে তৈমুর আলি সেটিই করে। এ তো মৃত্যু নয়, যেন দুঃসহ গণ্ডি থেকে অলৌকিক মুক্তি!), নাকি পানি পান করার মতো সাদামাটা জীবনযাপন করে যাবেন! কিন্তু, কী করে বলি, এটিই এই গল্পের ব্যাখ্যা!
আরেকটি উদাহরণ দিই। তাঁর মুখের দিকে দেখি উপন্যাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মামুন মিঞা বালক বয়সে করাতকলে কাঠের ভূষি আনতে গিয়ে চোরাই সারের ট্রাকে করে চট্টগ্রামে পাচার হয়ে যায় এবং সেখানে শিশু আসমানতারার খরগোশ হিসেবে খাঁচায় বন্দী অবস্থায় নতুন জীবন শুরু করে! শহীদুল জহিরের উপন্যাসে এ রকম অভিনব ঘটনা অহরহ ঘটে। প্রশ্নটা সেখানে নয়, অন্য জায়গায়। যে মামুন চট্টগ্রামে পাচার হয়ে যায়, সেই একই মামুন একই সময়ে তার পুরান ঢাকার বাড়িতে ফিরে আসে এবং তার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বহমান থাকে। অর্থাৎ একই ব্যক্তি দুই ভিন্ন বাস্তবতায় দুজন ভিন্ন মানুষ হিসেবে বড় হতে থাকে। ভিন্ন বাস্তবতার কারণে তাদের জীবনযাপন ও মানসগঠন আলাদাভাবে গড়ে ওঠে। ঢাকার মামুন কোমল স্বভাবের, পড়াশোনা শেষ করে একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, জুলির প্রেমে কাতর হয়ে থাকা যুবক; আর ওদিকে সাতকানিয়ার মামুনের বহুদিন পর্যন্ত খাঁচার মধ্যে এক বন্দী জীব হিসেবে বড়ো হওয়া, যৌবনপ্রাপ্ত হলে কামুক ও হিংস্র এক মানুষে পরিণত হওয়া, একাধিক খুন ও অবাধ যৌনতা, চোরাচালান ও অস্ত্রবাজি; আর আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা মানুষ। প্রশ্ন হলো, লেখক হিসেবে তিনি একই ব্যক্তির দুটি সমান্তরাল জীবন দেখালেন কেন? এর কারণ কি এই যে একটি মাত্র ঘটনার সামান্য ওলটপালটে—ভূষি আনতে গিয়ে ফিরে আসা ও না আসার পার্থক্যে একজন মানুষের জীবন আমূল বদলে যেতে পারে? নাকি একই মানুষের দুটো সমান্তরাল জীবনযাপন করার ইসলামিক মিথের আধুনিক ব্যবহার করে দেখালেন লেখক? কে জানে, কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি! উপন্যাস পড়তে গিয়ে যদি এত জটিল ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে ‘আরাম’ পাওয়া যাবে কীভাবে? বাংলা উপন্যাসের পাঠকেরা যে বড় আরামপ্রিয়!
যা হোক, এ রকম উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়। শহীদুল জহির হয়তো অভিনবত্ব পছন্দ করতেন এবং হয়তো সে জন্যই আখ্যান বর্ণনার প্রচলিত ভঙ্গি থেকে তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাসকে মুক্তি দিয়েছিলেন। বর্ণনার ভাষা ও আঙ্গিকে এনেছিলেন এমন এক পরিবর্তন, যা বাংলা ভাষায় আর কখনো কেউ করেননি, হয়তো করবেনও না। ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং কালপরম্পরা রক্ষার দায়ও তিনি বহন করেননি কখনো, বরং এক কাল থেকে অন্য কালে বা সময়ের এক তল থেকে অন্য তলে যাতায়াত করতে কথাশিল্পীদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তিনি সেই গুরুতর সমস্যা থেকেও নিজেকে মুক্ত রাাখতে পেরেছিলেন, তাঁর এই যাতায়াত ছিল অনায়াসসাধ্য। অনেক লেখাতেই টাইম-ফ্রেমের ধারণাকে ভেঙে দিয়েছেন তিনি—অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে এক জাদুকরি ভাষায় মিলিয়ে-মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছেন। বর্ণনায় ব্যবহার করতেন প্রচুর সংশয়বাচক শব্দ, যেন সংশয়ের বন্যা বইয়ে দিতেন, যেন কোনো ব্যাপারেই কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত পাঠককে নিতে দেবেন না তিনি! যেমন: ‘তখন একদিন সুপিয়া আকতার যেন কোথায় গেছিল, গেলে ফিরা আসতে হয়, তাই কোত্থেকে যেন সে ফিরা আসে; তার পরনে বোধহয় শাড়ি অথবা হয়তো সালোয়ার কামিজই ছিল, সঙ্গে যেন কে, হয়তো তার আম্মা, না হয় দাদি আম্মা।’ বর্ণিল সব চরিত্র তৈরি করতেন তিনি, আর তাদের মুখের কথা—সাহিত্যের ভাষায় যাকে ডায়লেক্ট বলা হয়, তাঁর গল্প-উপন্যাসে কী যে অসাধারণ কুশলতায় নির্মিত, না পড়লে বোঝা যাবে না। কিন্তু এসব রহস্যময় আখ্যান তিনি রচনা করতেন কেবল একটি ‘গল্প’ বলার জন্যই নয়, বরং নির্মাণ করতেন এমন এক বাস্তবতা, যার ভেতরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা উত্থান-পতনময় ঘটনাপ্রবাহ যেমন থাকত, তেমনি থাকত সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং একই সঙ্গে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ তীক্ষ বিদ্রূপ দিয়ে ক্রমাগত বিদ্ধ করে গিয়েছেন সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বেনিয়া বাণিজ্য প্রবণতাকে। সারা জীবন ধরে বিরামহীনভাবে গভীর সংবেদন নিয়ে তিনি আমাদের জীবনের ছবি এঁকে গিয়েছেন এবং এসব বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কথাকার।
সত্যি কথা বলতে কী, এত অল্প পরিসরে তাঁর সম্বন্ধে প্রায় কিছুই বলা হয়ে ওঠে না, এ কেবল তাঁর প্রয়াণ দিবসে এক অনুজের শ্রদ্ধা নিবেদনের ছোট্ট আয়োজন।