নারায়ণগঞ্জে দুই বছরে একইভাবে চার খুন

মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকির মতো একই কায়দায় গত দুই বছরে নারায়ণগঞ্জে আরও তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র একটি হত্যা মামলায় পুলিশ গত মাসে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তবে ওই দুজনই ছয় মাস ধরে নিখোঁজ। স্থানীয় লোকদের ধারণা, তাঁদের গুম করা হয়েছে।একইভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার অপর তিনজন হলেন ব্যবসায়ী আশিক ইসলাম ও ভুলু সাহা, তরুণ নাট্যকার ও ছাত্র দিদারুল আলম চঞ্চল। তানভীরসহ এই চারজনেরই লাশ পাওয়া গেছে নিখোঁজ হওয়ার এক থেকে তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে। তাঁদের নির্যাতন ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যেকেরই অণ্ডকোষ ছিল থেঁতলানো। এসব কারণে নারায়ণগঞ্জবাসীর ধারণা, এই চার হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা এবং এগুলো ঘটিয়েছে একই চক্র। এ জন্য তাঁরা সন্দেহ করছেন জেলার প্রভাবশালী একটি ‘বিশেষ পরিবারকে’।তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এলাকাবাসী সন্দেহ করলেও এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো সূত্র মেলেনি। আর সূত্র ছাড়া ওই পরিবারের কোনো সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা পুলিশের পক্ষে অনেকটা অসম্ভব। তবে ওই পরিবারের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ না করলে এসব মামলার তদন্ত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।নারায়ণগঞ্জবাসী বলেছেন, তানভীরের আগে একইভাবে হত্যার শিকার তিনজনের মধ্যে দিদারুল ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ওই ‘বিশেষ পরিবারের’ বিপক্ষে কাজ করেছিলেন। ওই নির্বাচনে তানভীরের বাবাও ওই পরিবারের বিপক্ষে কাজ করেন। ব্যবসায়ী আশিকের সঙ্গে ওই পরিবারের এক তরুণ সদস্যের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামান্য বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ভুলুকে চাঁদার দাবিতে হত্যা করা হয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা।আশিক হত্যাকাণ্ড: নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আশিককে ২০১১ সালের ১১ মে রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যান সিজার ও সিদ্দিক নামের দুই যুবক। এর দুই দিন পরে শীতলক্ষ্যা থেকে আশিকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর মুখমণ্ডল ছিল অ্যাসিডে ঝলসানো। পুলিশ জানিয়েছিল, তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল, অণ্ডকোষ ছিল থেঁতলানো।আশিক ছিলেন সর্বশেষ নিহত কিশোর তানভীরের বাবা রফিউর রাব্বির ফুফাতো বোনের ছেলে।আশিক হত্যার ঘটনায় তাঁর বড় ভাই ফাহিমুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় সিজার ও সিদ্দিককে আসামি করে মামলা করেন। এই দুজনই এলাকায় ওই ‘বিশেষ পরিবারের’ অনুসারী সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সিজারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও রয়েছে।সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মঞ্জুর কাদের বলেন, আশিক হত্যার তদন্ত শেষে সিজার ও সিদ্দিককে অভিযুক্ত করে গত মাসে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিজার ও সিদ্দিক ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। এলাকাবাসীর ধারণা, তাঁদের গুম করা হয়েছে।তবে মামলার এ অবস্থায় প্রথম আলোর কাছে হতাশা প্রকাশ করেন বাদী ফাহিমুল।দিদারুল হত্যা: নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্র দিদারুল আলম তরুণ নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিলেন। ওই নির্বাচনে আইভী বিজয়ী হন। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১২ সালের ১৩ জুলাই ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীতে মঞ্চস্থ হওয়া ১০০টি নাটকের মধ্যে দিদারুলের রচিত বক্তাবলীও ছিল। নাটকটির জন্য তিনি পুরস্কৃতও হন। ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন তিনি। পরদিন শীতলক্ষ্যা থেকে পুলিশ একটি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহায়তায় মাসদাইর কবরস্থানে দাফন করে। পরে লাশের ছবি ও পরনের কাপড় দেখে স্বজনেরা দিদারুলের লাশ শনাক্ত করেন।এ ঘটনায় প্রথমে মামলা হয় বন্দর থানায়। পরে তা তদন্তের জন্য ডিবিতে পাঠানো হয়। পরিবারের ধারণা, নির্বাচনে আইভীর পক্ষে কাজ করায় তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর পিঠে ধারালো অস্ত্রের একটি আঘাত, অণ্ডকোষ থেঁতলানো ও গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন ছিল। মামলাটির তদন্ত চলছে।জেলা ডিবি সূত্র জানায়, এ মামলার কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। তদন্ত চলছে।ভুলু সাহা হত্যা: টানবাজারের রং ও সুতা ব্যবসায়ী প্রাণ গোবিন্দ সাহা ওরফে ভুলু সাহা চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চা পান করতে বেরিয়ে আর ফেরেননি। ২৯ জানুয়ারি তাঁর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই জায়গাতেই গত শুক্রবার পাওয়া যায় মেধাবী কিশোর তানভীরের লাশ।তানভীরের মতো ভুলুকেও একই কায়দায় নির্যাতন ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। টানবাজারের ব্যবসায়ীদের ধারণা, চাঁদার দাবিতে ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতেই ভুলুকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার ব্যাপারে নিহত ভুলুর বড় ভাই গৌর গোপাল সাহা সদর থানায় মামলা করেন। তবে এ মামলায়ও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।ওসি মঞ্জুর কাদের বলেন, ব্যবসায়ী ভুলু হত্যার বিষয়ে সন্দেহভাজন তিনজনকে খোঁজা হচ্ছে। এদের ধরা গেলে মামলার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।তবে এলাকাবাসী ও সম্প্রতি নিহত তানভীরের স্বজনদের আশঙ্কা, এই তিনজনের খুনিদের মতো তানভীরের খুনিরাও ধরা পড়বে না। তানভীরের পরিবারও ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা বারবারই ব্যক্ত করেছে গণমাধ্যমের কাছে।তবে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম গতকাল সোমবার বলেন, তানভীরের হত্যাকারীদের ধরতে জেলা পুলিশের পাশাপাশি ডিবিও কাজ করছে। পুলিশের একাধিক দল মাঠে রয়েছে।