ধর্মভিত্তিক দলগুলোতে তিনটি ধারা

কথিত নাস্তিক ব্লগারদের কঠোর শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভেতরে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। একটি ধারা হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আরেকটি ধারা হেফাজতের বিরোধিতা করে সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর তৃতীয় ধারাটি পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকে।তিনটি ধারার দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হেফাজতের আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত সরকার নাকি বিরোধী দল লাভবান হবে; তা নিয়েই কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের বিভক্তি তৈরি হয়। হেফাজতের আন্দোলনের কারণে সরকার বেকায়দায় পড়ুক বা জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক সুবিধা পাক; তা চায় না সরকার-সমর্থক ধর্মভিত্তিক দলগুলো। অন্যদিকে, মুখে স্বীকার না করলেও হেফাজতের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার আকাঙ্ক্ষা ও প্রস্তুতি ছিল বিএনপি ও জামায়াতের।হেফাজতের পক্ষের ধারা: কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক অধিকাংশ দল, সংগঠন, প্রভাবশালী আলেম ও অঞ্চলভিত্তিক ওলামা-মাশায়েখরা হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটভুক্ত ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস (ইসহাক), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (মোমিন) ও নেজামে ইসলাম পার্টি (রকিব) যুক্ত আছে। এসব দলের নেতারাও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও জেলা কমিটিগুলোর বিভিন্ন পদে আছেন।বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে হাফেজ্জী হুজুরের ছেলে শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর নেজামে ইসলাম পার্টিও হেফাজতের আন্দোলনে যুক্ত আছে। এর মধ্যে খেলাফত আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক ছিল। ২০০৬ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে ফতোয়ার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ পাঁচ দফা দাবিতে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছিল। এক-এগারোর পটপরিবর্তনের কারণে ওই নির্বাচন হয়নি। পরে ওই চুক্তি আওয়ামী লীগ বাতিল করে। এখন খেলাফত মজলিসের আমির হলেন সিলেটের কাজীরবাজার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সময় আফগানিস্তান সফরসহ জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া মুফতি ইজহারুলের নেজামে ইসলাম পার্টিও ওই নির্বাচন সামনে রেখে ২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেয়। এ তিনটি দলের নেতারাও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটিতে আছেন।এ দলগুলো বাইরে আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী আলেমরাও লংমার্চে সমর্থন জোগান। তাঁদের মধ্যে সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মুফতি আবদুর রহমান, চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক আবদুল হালিম বোখারী, দারুল মা’আরেফের পরিচালক সুলতান যউক নদভী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাওলানা মনিরুজ্জামান সিরাজী, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মুহাম্মদ আবদুল জব্বার, বরিশালের শর্ষীনার পীর মাওলানা মহিব্বুল্লাহ ও তাঁর দল জমিয়তে হিযবুল্লাহ, সিলেটের ফুলতলীর পীরের দল আল ইসলাহ উল্লেখযোগ্য।হেফাজতবিরোধী ধারা: হেফাজতের আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করে বক্তৃতা, বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন করেছে সরকার-সমর্থক অনেকগুলো ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠন। এর মধ্যে মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, হাফেজ জিয়াউল হাসানের বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট, নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, এম এ মান্নানের বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, বাহাদুর শাহ মোজাদেদ্দীর ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ও কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমীর নেতৃত্বাধীন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত অন্যতম। এর মধ্যে প্রথম দুটি দল ছাড়া বাকিগুলো খানকাপন্থী। তারা আদর্শিকভাবে জামায়াত ও কওমি—দুই ধারারই বিরোধী।বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট ৬ এপ্রিল হেফাজতের লংমার্চের পাল্টা সমাবেশও ডেকেছিল। পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়। দলটির প্রধান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হেফাজতের দাবির বিরোধী না। আমরা মনে করি, আলোচনা করে এর সমাধান করা যায়। সমস্যা হচ্ছে, এ সময়ে লংমার্চ করলে অন্যরা এর সুযোগ নিতে পারে।’এ ছাড়া আওয়ামী ওলামা লীগের একাংশের সভাপতি আখতার হোসাইন বোখারী ‘বাংলাদেশ খেদমতে ইসলাম পরিষদ’ এবং ওলামা লীগের আরেকাংশের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ‘সম্মিলিত ইমাম ও মুয়াজ্জিন পরিষদের’ ব্যানারে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি ও মানববন্ধনের মাধ্যমে হেফাজতের লংমার্চের বিরোধিতা করে। ওলামা লীগের একাংশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও খেদমতে ইসলাম পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ওলামা লীগকে স্বীকৃতি দেয় না এবং এ দলে বিশৃঙ্খলা আছে। এ কারণে আমরা ধর্মীয় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত নতুন অরাজনৈতিক সংগঠন করে জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ হেফাজত প্রশ্নে মধ্যপন্থী: কওমি ধারার দলগুলোর মধ্যে সাংগঠনিকভাবে অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থান আছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির হেফাজতের লংমার্চে সরাসরি অংশ নেয়নি আবার বিরোধিতাও করেনি। ধর্মীয় সংবেদনশীল বিভিন্ন দাবিতে গত ৯ মার্চ হাটহাজারী মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন দলটির নেতারা। পরে লংমার্চে সমর্থনের কথাও জানান। দলটির সঙ্গে সরকারের এক ধরনের যোগাযোগ রয়েছে বলে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে প্রচার আছে। সমর্থন দেওয়ার পরও হেফাজতের কর্মসূচি বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তার কারণ জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমাদ মহাসমাবেশের আগে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উপস্থিতি নির্ভর করবে সরকার ১৩ দফার দাবির ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়, তার ওপর। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা হেফাজতের সঙ্গে নেই।’কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলা নিয়ে গঠিত সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি রুহুল আমিনসহ আলেমদের একটি ছোট অংশ হেফাজতের আন্দোলনে জড়াননি। আবার বিরোধিতাও করেননি। বরং তাঁরা সরকারের পক্ষ হয়ে হেফাজতের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিলেন বলে প্রচার আছে। তাঁরা গত ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেন। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ও কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে মাওলানা মাসউদ বাংলাদেশ ওলামা-মাশায়েখ তৌহিদি জনতা সংহতি পরিষদের ব্যানারে গত মাসে মতিঝিলে সমাবেশ করেন। বিগত বিএনপি সরকার আমলে ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার পরপর মাওলানা মাসউদকে জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অবশ্য এ অভিযোগ পরে প্রমাণিত হয়নি। আর বর্তমান সরকার তাঁকে শোলাকিয়ার ইমাম নিযুক্ত করেন।ফরিদ উদ্দিন মাসউদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌলিকভাবে হেফাজতে ইসলামের কথাগুলোর সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। তবে, এসব দাবির সঙ্গে আমরা জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা ও মওদুদীর বই বাজেয়াপ্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলাম হেফাজতকে।’