দান-দক্ষিণার রমজান মাস

আজিজনের বয়স ৭০ বছর। কলতাবাজারের আদি বাসিন্দা। বছরের ১১টা মাসই কাটে কষ্টেসৃষ্টে। তবে বছর দশেক ধরে রমজান মাস এলে খাবারের কষ্টটা দূর হয়ে যায়। কলতাবাজার পঞ্চায়েত কমিটির দান করা ভোগ্যপণ্যের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ‘এই জিনিসপত্র না পাইলে কষ্ট হইত। রোজা থাইকা দোয়া করব; আমাগো যারা দেয়, আল্লায় তাগো দেউক’, বললেন আজিজন।আজিজনের সঙ্গে কথা হয় ৯ আগস্ট রাত ১১টায়। কলতাবাজার পঞ্চায়েত কমিটির কার্যালয়ে রমজান মাসের নিত্যপ্রয়োজীয় পণ্যসামগ্রী নিতে এসেছিলেন তিনি। ওই রাতেই কমিটি কলতাবাজারের ৮৫০টি পরিবারকে রমজান মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করে। তাদের দেওয়া ভোগ্যপণ্যের ফর্দটা এমন, মিনিকেট চাল ২০ কেজি, মটর ডাল দুই কেজি, মসুর ডাল তিন কেজি, সয়াবিন তেল পাঁচ লিটার, ময়দা চার কেজি, লবণ এক কেজি, চিনি তিন কেজি, গুঁড়ো দুধ এক কেজি, ইস্পাহানি চা-পাতা ৪০০ গ্রাম, খেজুর দুই কেজি, গুঁড়ো সাবান এক কেজি ও গায়ে মাখার সাবান দুটি।শুধু কলতাবাজার পঞ্চায়েত কমিটি নয়, রমজান মাস এলে আরও অনেকেই দান-খয়রাত করে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে এ সময়ে জাকাত দেওয়া ও দান করার মাত্রা বেড়ে যায় ঢাকা নগরে। কেউ দান করেন নগদ অর্থ, কেউ ভোগ্যপণ্য। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে ইফতারি তৈরির পণ্য যেমন থাকে, তেমনি থাকে সেহিরর পণ্য। সন্ধ্যা নামার আগেই কেউ আবার বিতরণ করেন রান্না করা ইফতারি। বিশেষ করে নগরের মসজিদে মসজিদে যে ইফতার আয়োজন দেখা যায়, তা হয়ে যায় বিভিন্ন জনের দেওয়া ইফতারি থেকেই। মসজিদের পাশাপাশি এতিমখানায়ও ইফতারির পদ পৌঁছে দেন অনেকে। আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় বছর দশেক ধরে এক ভদ্রলোক এভাবে ইফতারি নিয়ে আসেন সন্ধ্যা নামার আগেই। তাঁর কল্যাণেই হয়ে যাচ্ছে ২৮৫ জন শিক্ষার্থীর ইফতারের খাবার। মানুষের দান-অনুদানেই হচ্ছে এতিমখানাটির তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর পড়া ও খাওয়া খরচের একাংশ। নগদ টাকা ছাড়াও এখানে বই-পুস্তক, পোশাকআশাক দান করছেন অনেকেই। দান-অনুদানের খাতে রমজান মাসেই সবচেয়ে বেশি আয় হয় এতিমখানাটির। এখন অনেকেই এখানে এসে নগদ টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনই একজন পুরোনো ঢাকার মৌলভীবাজারের হাজি মোহাম্মদ কিসমত। নিজের অর্থ ছাড়াও তিনি আরও কয়েকজনের দানের নগদ টাকা নিয়ে এসেছিলেন এতিমখানায়। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর মৌলভীবাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ী এখানে দান করেন। আমি নিজে দিতাছি ১৫ বছর ধরে।’প্রতিষ্ঠাকাল ১৯০৯ সাল থেকেই সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা রমজান মাসে মানুষের জাকাত ও দানের টাকা পাচ্ছে বলে জানান স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার বাজার কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী। তারও দেড় দশক আগে রমজান মাসে ঢাকায় দান-খয়রাত ও জাকাত দেওয়ার চিত্র কেমন ছিল, তা জানা যায় ঐতিহাসিক হাকিম হাবিবুর রহমানের বিবরণ থেকে। ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে গ্রন্থে তিনি লিখেছেন (মোহাম্মদ রেজাউল করিম অনূদিত), রমজান মাসে ক্ষমতাবান ও উদ্যমী ঘর থেকে মহল্লার মসজিদে ইফতারসামগ্রী পাঠানো হতো। কেউ প্রতিদিন, কেউ শুধু বৃহস্পতি কিংবা শুক্রবার মসজিদে ইফতার পাঠাতেন। অনেকে মসজিদে শরবত পাঠাতেন। সম্পদশালী ব্যক্তিরা ১০ রমজানের মধ্যেই তাঁদের জাকাতের পরিমাণ হিসাব করে রাখতেন। কেউ জাকাত হিসেবে নগদ অর্থ দিতেন, কেউ বা দিতেন শাড়ি।এখন শাড়ির পাশাপাশি লুঙ্গিও জাকাত হিসেবে অনেকে দিয়ে থাকেন। তবে বছর কয়েক আগে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি আনতে গিয়ে ভিড়ের চাপে মানুষ মারা যাওয়ায় নগরে এখন ঘোষণা দিয়ে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গির দেওয়ার প্রচলন কিছুটা কমেছে বলে জানান পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা ও মাওলা বকশ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা আজিম বকশ। তিনি বলেন, এলাকার গরিবদের তালিকা করে তাঁরা ট্রাস্টের পক্ষ থেকে তাঁদের টাকা, শাড়ি ও লুঙ্গি দিয়ে থাকেন।ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) ৯০টি ওয়ার্ডে দুস্থ মানুষের মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এর একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের ৭৮ জন সদস্যের মাধ্যমে এই কার্যক্রম চালানো হবে। বিত্তবান ব্যক্তিদের জাকাতের খাত থেকে পাওয়া অর্থেই আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের দাতব্য কাজের বেশির ভাগ অর্থ জোগাড় হয়।এদিকে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গিকে ঘিরে নগরের বস্ত্রবাজারে আলাদা দোকান বসে গেছে। ইসলামপুর রোড, মতিঝিল, বঙ্গ মার্কেটের অনেক দোকানের সামনে ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এখানে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি সুলভ মূল্যে বিক্রি করা হয়।’ ইসলামপুর রোডে রয়েছে তিনটি দোকান। এখানকার সোনারগাঁও বস্ত্রবিতানের বিক্রয়কর্মী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তাঁরা শুধু রমজান মাসে দোকান নিয়ে বসেন। তাঁদের শাড়ির মূল্য ১৫০ থেকে ২৩০ টাকা। বেচাবিক্রি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিপা রাস্তার কারণে এখানে প্রাইভেট কার ঢোকে না। তাই ঢাকা শহরের যাঁরা জাকাত দেন, তাঁরা খুব একটা এখানে আসেন না। ঢাকার বাইরের ক্রেতারা এখানে বেশি আসেন। ঈদের কেনাকাটা করতে ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতার পাশাপাশি ভিক্ষুক আসছে নগরে। তাই পথেঘাটে, বাসাবাড়ি, মসজিদের পাশে এখন ভিক্ষুকের আনাগোনা বেশি। জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি, টাকা সংগ্রহ করাই তাদের লক্ষ্য। ঈদের দিন ফিতরার অর্থ নিয়ে ঘরে ফিরবে এদের অনেকে। কেউ কেউ বাড়ি ফিরবে মাস তিনেক পর, একেবারে ঈদুল আজহার মাংস ও চামড়ার টাকা সংগ্রহ করার পর।