সাপলুডু খেলা

সত্তরের দশকের শেষ আর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তখন নিয়মিত লেখেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘গাছপাথর’ ছদ্ম নামে। সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়গুলোর অসাধারণ বিশ্লেষণ থাকে সেখানে। বৈঠকি ঢঙে অনন্য সুন্দর গল্প বলে যান ‘দরবার-ই-জহুর’ শিরোনাম দিয়ে প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী। ‘হৃৎ কলমের টানে’ লেখেন সৈয়দ শামসুল হক। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের অনন্যসাধারণ বিশ্লেষণ, বাঙালির মন ও মননের কথা থাকে সেখানে। তরুণ বয়সী যারা লেখালেখি করেন, দুনিয়ার তাবৎ সাহিত্য সংস্কৃতির তথ্য যারা হাতের মুঠোয় রাখতে চান; বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আলোচনায় নতুন তথ্য দিয়ে যারা মাত করে দিতে চান; তারা গোগ্রাসে ‘হৃৎ কলমের টানে’ পড়েন।
মনে আছে কী অসাধারণ বিতর্ক, শেক্‌সপিয়ারের ম্যাকবেথের ট্র্যাজেডির উপকরণ নিয়ে দুই সৈয়দের মধ্যে। সৈয়দ শামসুল হক ম্যাকবেথের আলোকে একটি সাধারণ নাটক লেখেন ‘ঈর্ষা’ নামে। সেই নাটকের কুশীলবদের নিয়ে, তাদের চরিত্রের ভেতরে বহমান অনুভূতিগুলো নিয়ে চুলচেরা আলোচনা। এক সৈয়দ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির তরুণ অধ্যাপক, লেখালেখি শুরু করেছেন।তিনি সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম; আরেক সৈয়দ তখন সুপ্রতিষ্ঠিত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কী যে রুচিসম্মত বিশ্লেষণ, তত্ত্ব, তথ্য নিয়ে লড়াই, আমাদের মতো তরুণেরা গোগ্রাসে গিলি সব অজানা তথ্য ও বিশ্লেষণ। অরুচিকর, মর্যাদাহানি ঘটে এমন কোনো কথা নেই। পাঠক ‘হৃৎ কলমের টানে’ পড়ে সমৃদ্ধ হয়, ঋদ্ধ হয়। আহা তরুণ বয়সে এগুলো আমাদের জন্য ছিল অসাধারণ প্রাপ্তি।
মূলত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি আফসোসের কথা মনে পড়ায় এত স্মৃতি অবচেতন মন থেকে উপচে উঠল। ‘দৈনিক সংবাদের’ সেই স্বর্ণ প্রসবিনী সময় নিয়ে আরেক দিন লেখার ইচ্ছা আছে। মূল প্রসঙ্গে আসি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় প্রায়ই একটি হতাশার কথা শুনতে পেতাম। তা হলো তরুণদের সামনে কোনো অনুসরণীয় নায়ক নেই, আছে শুধু খলনায়ক। তাঁর এই হতাশা বারবার উচ্চারিত হতো। সামনে এগিয়ে যেতে হলে তরুণদের সামনে, অনুসরণ করার মতো আদর্শ ধারণ করার মতো নায়ক থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট। এর মধ্যে জেলের ভেতরে ঢুকে নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, জাতীয় চার নেতাকে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। সারা জাতি থরথর করে কাঁপছে। শূন্যতা বিরাজ করছে, বাঙালির হৃদয়ের গহিনে। এই শূন্যতাকে জাতির জন্য, জাতীয় জীবনের জন্য ‘শোকসভার’ মতো পরিবেশ বলে মনে করতেন অনেক কবি। বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধে, সে অঙ্গীকার থেকে জাতির দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য নানা আয়োজন সামরিক সরকারের নেতাদের। এমন দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল নেতৃত্বের। আর এই নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন একজন নায়কের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, সবচেয়ে জোর গলায় যিনি জাতীয় নায়কের জন্য রোদন করতেন, উচ্চ স্বরে কথা বলতেন তিনি হলেন আজকের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। দম বন্ধ করা এ রকম পরিবেশে তরুণেরাও ধীরে ধীরে তা অনুভব করা শুরু করল। এই অনুভব তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি।
বহুদিন থেকে আমরা নায়কের জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা নাকি মধুর। হ্যাঁ সে অপেক্ষা থেকে নায়ক না পেলেও অসংখ্য খলনায়ক পেয়েছি আমরা। সামরিক সরকারের নেতারা রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য খলনায়কদের জন্ম দিতেন। যে বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল সামরিক সরকারের আমলে, সে বিষবৃক্ষ অথবা সে ধরনের রাজনীতি আজ বাংলাদেশে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি যারা করেন দীর্ঘদিন থেকে, তাদের কী দরকার ছিল এই ধারা বহন করার? কিংবা যারা সামরিক লেবাস ছেড়ে জনগণের কাতারে এসে দীর্ঘ দিন জনগণকে নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন, তাদেরও ত্যাগ করা উচিত ছিল এই ‘খল রাজনীতি’। তাদের সামনে উজ্জ্বল, অনুকরণযোগ্য উদাহরণ ছিল। মানুষের শক্তিকে ভর করে উঠে দাঁড়ানোর উদাহরণ, যা দেখিয়ে গেছেন আমাদের অনেক জাতীয় নেতা। মানুষের শক্তি যে তথাকথিত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিকে পরাভূত করতে পারে তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ হলো আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বৈষম্য নিরসনের রাজনীতিকে এড়িয়ে পুঁজির অর্থনীতির স্বাদ আমরা যেদিন পেয়েছি, সেদিন থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা কোলে তুলে নিয়েছি। আমরা প্রশ্রয় দিয়েছি পেশি শক্তিকে। ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীদের ধরে নিয়ে আমরা পেশির রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এ কাজগুলো শুরু করেছিলেন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে দল গঠন করে যারা রাজনীতির আসরে স্থায়ী আসন লাভ করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা। তাঁদের গণভিত্তিকে মজবুত করার জন্য অছাত্রদের ছাত্র বানিয়ে, তাঁদের প্রকৃত ছাত্রদের নেতা পর্যন্ত বানানো হয়েছিল। সামরিক আমলা, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি, এমনকি জেলা শহরের চেম্বার নেতাদেরও রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়। ধীরে ধীরে রাজনীতি স্থানচ্যুত হতে থাকে। রাজনীতি চলে যায় ব্যবসায়ী, আমলাদের হাতে। সারা দেশে ওই যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়, সে সিন্ডিকেট ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে।
সংসদে আইন প্রণয়ন হয়। প্রশ্ন হলো, কার জন্য কে আইন প্রণয়ন করে। ব্যবসায়ীরা যদি, ব্যাংকঋণের সুদহার নিয়ে আইন তৈরি করেন, সে আইন কি জনবান্ধব হতে পারে? আমাদের সাংসদেরা ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, পরিবহন মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার প্রোফাইল সমৃদ্ধ সাংসদ কোথায়। বড় বড় করপোরেট হাউসগুলোর মালিক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই আছেন সংসদ সদস্য হিসেবে। সাংসদদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তৃণমূল রাজনীতি করে প্রক্রিয়ার মধ্যে বেড়ে ওঠা সংসদ সদস্যদের সংখ্যা এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাজনীতির প্রক্রিয়াকে আমরা গলা টিপে মেরে ফেলছি। তৃণমূলের ত্যাগী নেতারা এখন জানেন, তাঁদের ধাপে ধাপে সামনের দিকে এগোনোর পথ নেই। সামনের দিকের পিলারগুলো সব বিক্রি হয়ে গেছে অথবা হতে যাচ্ছে।
এই যে কেনা-বেচার রাজনীতি, তারই বাইপ্রোডাক্ট হলো, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সব অপকর্ম কিংবা অপতৎপরতা। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের নামে এগুলো করা খুব সহজ। প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রতারক ব্যবসায়ীরা সব অপকর্ম করে থাকেন রাজনীতির নামে, রাজনৈতিক দলের নামে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা আছেন সর্বাগ্রে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যেকোনো পরিস্থিতিতে জিনিস-পত্রের দাম না বাড়ানোর একটা শৃঙ্খলা আছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো দেশে মৃতের সংখ্যা বাড়লে ‘কাফনের কাপড়’ কিংবা ‘চিতার খড়ির’ দাম বাড়িয়ে দিতে আমাদের ব্যবসায়ীরা একটুও কুণ্ঠাবোধ করেন না। মিডিয়া ও প্রশাসন যখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত, তখন বস্তি পুড়িয়ে দালানের ব্যবসার আয়োজন করতেও দ্বিধা নেই আমাদের ক্ষমতার কারিগরদের। এ রকম অপকর্মগুলো আমাদের সব অর্জনকে ক্রমান্বয়ে ধূসর করে দিচ্ছে। সিস্টেম বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে টেকসই করার প্রতিযোগিতায় আমরা উল্টো পথে হাঁটার কৌশল অবলম্বন করছি।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আমরা আসলে রাজনীতিকে হত্যা করেছি। রাজনীতিকে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদেরও ধীরে ধীরে সাইডলাইনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এমন করে যদি শেষ পর্যন্ত রাজনীতি নির্বাসনে চলে যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের আবার অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে। সাপলুডু খেলার মতো একবার দ্রুত এগোব, আরেকবার শূন্যের ঘরে প্রত্যাবর্তন ঘটবে। রাজনীতির মাঠে পেছনের খেলোয়াড় হবেন সামরিক আমলা, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি এবং সামনে খেলবেন মুরগি মিলন, সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, সাহেদ, সাবরিনা কিংবা এমন নামের অনেকে। সামনে যারা খেলবে প্রয়োজনে তারা খুব সক্রিয় হবেন আবার প্রয়োজনে তাদের সরে যেতে হবে। তাদের থাকা না থাকা আসলে নির্ধারণ করবেন পেছন থেকে সুতা ধরে থাকা ব্যক্তিরা।
টুঙ্গিপাড়ার গহিন গ্রাম থেকে উঠে এসে শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে মুজিবর, শেখ মুজিব, শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। সে রকম প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় শুধু শেখ মুজিবুরর রহমানকেই নয়, জন্ম দেয় তাঁর পার্শ্বনায়ক তাজউদ্দীনের মতো বিশ্বস্ত নেতাদের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাহসী নেতৃত্বে সব বোঝা মাথায় তুলে নিচ্ছেন। আমরা তাঁর আশপাশে চাই জাতীয় চার নেতার মতো মানুষদের। আমরা চাই মুজাফফর আহম্মেদ, মণি সিংহসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দল থেকে এসে দলীয় সংকীর্ণতা ভুলে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যেসব নেতারা, তাঁদের মতো নেতাদের। এ রকম মানুষদের নেতৃত্ব কার্যকর হবে তখন, যখন রাজনীতি চলবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, আর রাজনীতির স্টিয়ারিং হুইল থাকবে রাজনীতিকদের হাতে। রাজনৈতিক নেতাদের সামনে রেখে আমরা আর আমলাদের ছদ্ম শাসন চাই না। সাপলুডু খেলা অনেক হয়েছে। যে খেলায় আমরা মই বেয়ে অনেক ওপরে উঠেছি, আবার সাপের মুখে পড়ে আমদের অপ্রত্যাশিত পতনও হয়েছে অনেকবার। আমরা চাই মাটিতে থাকা মানুষের নেতাদের শাসন। যে শাসনে দিনের শেষে মানুষেরাই বিজয়ী হয়।