ফাহিম সালেহ হত্যার প্রতিবাদে নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের বিক্ষোভ
বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নিউইয়র্কে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ২১ জুলাই বিকেলে ইস্ট হাউস্টনে নিহত ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এই সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটি কাউন্সিল।
বিক্ষোভ সমাবেশে ফাহিম সালেহর হত্যার বিচার নিশ্চিত করার জন্য অধিকতর তদন্তের দাবি জানানো হয়। সভায় উপস্থিত বাংলাদেশি নাগরিক সংগঠকেরা ফাহিম সালেহর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তাঁরা নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অপরাধ আইনের সংস্কারেরও দাবি জানিয়েছেন।
ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। নিউইয়র্কসহ আমেরিকার সর্বত্র এ নিয়ে আলোচনা থামছে না। গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে আগামী ১৭ আগস্ট আদালতে হাজির করা হবে। এর মধ্যে ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত কোনো পর্যায়ে যায়, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই। ১৯ জুলাই পারিবারিক আয়োজনে নিউইয়র্ক আপস্টেট উইন্ডসর শহরে নূর মুসলিম কবরস্থানে ফাহিমের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল ম্যানহাটানের ইস্ট ২৬৫ হাউস্টন স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টের সামনের এলাকাটি যেন শোকের মিনার হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন চেনা–অচেনা মানুষ ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করছেন তাঁকে।
নিউইয়র্কের বিলাসবহুল কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে প্রাইভেট লিফট থাকে। অভিজাত এসব অ্যাপার্টমেন্টের একেকটি ফ্ল্যাটের জন্য লিফট ডেডিকেটেড থাকে। ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্ট সাইডে ২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এ রকমই একটি ফ্ল্যাট ফাহিম কিনেছিলেন গত ডিসেম্বরে। ফাহিমের বিলাসবহুল এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের পুরো সপ্তম তলাজুড়ে। ভবনে তাঁর লিফট সাততলায় খোলে। লিফটের দরজাই অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা।
১৩ জুলাই বেলা ১টা ৪০ মিনিটে ফাহিম যখন লিফটে ওঠেন, তখন এক ব্যক্তিও তাঁর পিছু নিয়ে দ্রুত লিফটের ভেতর ঢুকে পড়েন। তদন্তকারীরা বলছেন, ওই ব্যক্তিই টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিল। তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যাগে ইলেকট্রিক করাত ছিল বলে তাঁদের ধারণা। লিফটের ভেতরের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ফাহিম ওই ব্যক্তিকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন। এরপর কিছু কথা বিনিময় হতে দেখা গেছে দুজনের মধ্যে। পর মুহূর্তে ফাহিমকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছিল।
ফাহিম লিফট থেকে ঘরের ভেতরে পা রাখতেই মাস্ক পরিহিত ওই ব্যক্তি ফাহিমকে আক্রমণ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, টেজার দিয়ে পেছন থেকে আঘাতের পর ফাহিম লিফট থেকে বের হতেই সামনের দিকে পড়ে যান। এরপর লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সিসি টিভির ফুটেজ আর রেকর্ড হয়নি। তদন্তকারীরা মনে করেন, এরপরই হ্যাসপিল ছুরিকাঘাত করে ফাহিমকে হত্যা করেন। পরে হ্যাসপিল কার সার্ভিস ডেকে হোম ডিপোয় চলে যান। কার সার্ভিসের সেই পেমেন্ট তিনি পরিশোধ করেছেন ফাহিমের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। হোম ডিপো থেকে কিছু ক্লিনিং আইটেমও কেনেন হ্যাসপিল।
ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের লিফটের সিসি টিভি ক্যামেরায় দেখা যায়, পরদিন ১৪ জুলাই দুপুরে আবার ফিরে আসেন হ্যাসপিল। সঙ্গে ছিল রিচার্জেবল ভ্যাকুম। পুলিশের মতে, ভ্যাকুমটি হত্যার পর লক্ষণ মুছে ফেলার চেষ্টায় ব্যবহার করা হয়েছিল।
পুলিশের ধারণা, ১৪ জুলাই দুপুরে ইলেকট্রিক করাত ব্যবহার করে ফাহিমের দেহ খণ্ড খণ্ড করেন হ্যাসপিল। এ সময় ফাহিমের বোন অ্যাপার্টমেন্টের দরজা নক করেন। তিনি পুলিশকে ‘ওয়েলফেয়ার চেকের’ (নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীর অপমৃত্যু হয়েছে এ রকম আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চাওয়া) অনুরোধ জানান। তবে পুলিশ আসার আগেই ভবনের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে হ্যাসপিল পালিয়ে যান। এরপরে পুলিশ আসে।
এখন পর্যন্ত ঘটনার বিবরণে এমন তথ্যই জানা গেছে পুলিশের পক্ষ থেকে। ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের সূত্র ধরেই ১৭ জুলাই প্রায় এক মাইল দূরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন না দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হ্যাসপিল এখনো কোনো তথ্য দেননি। তবে তিনি নিজেকে নিরপরাধ বলে দাবি করছেন।
ফাহিম সালেহ নিউইয়র্কে বাংলাদেশি জনসমাজের কাছে তেমন পরিচিত ছিলেন না। তাঁর বিচরণ ছিল বিশ্বের মূলধারার বিনিয়োগ ও সাফল্যের সিঁড়িতে। হত্যাকাণ্ডের পরই ব্যাপকভাবে প্রবাসীরা তাঁর কথা জানতে পারেন। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ওঠে ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ড।
বাংলাদেশি লোকজন এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছেন। এমনকি রাজ্যের আইন পরিবর্তন করারও দাবি উঠেছে। অতীতের বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের বিচারের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আনা অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি পেলেও হ্যাসপিলের মতো অপরাধী পুরো মেয়াদের কারাদণ্ড ভোগের আগেই প্যারোল পেতে পারেন। নিউইয়র্কের বর্তমান আইনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাজ্যের অপরাধ আইন সংস্কারের জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের দাবি জানানো হচ্ছিল। ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশিরাও এমন দাবি জানাচ্ছেন।